Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Constitution of India

স্বাধীনতাহীনতায়

প্রতিবাদ নাগরিকের অধিকার, এবং আন্তর্জাতিক শ্রোতৃমণ্ডলের প্রতি লক্ষ করিয়া কথা বলাও সেই অধিকারের অন্তর্গত।

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:২১
Share: Save:

দিল্লির পাটিয়ালা হাউস আদালতের বিচারকের রায় শুনিয়া মনে পড়িতে পারে জনপ্রিয় গানের সেই চিরায়ত পঙ্‌ক্তি: “...আবার চাহি শুনাবারে যে কথা শুনায়েছি বারে বারে।” সত্য বলিতে, সেই পুরাতন সত্যটি আবার এবং বার বার শুনাইবার গুরুতর প্রয়োজন পড়িয়াছে আজিকে। এই দেশের সংবিধান যে প্রতিবাদ কিংবা বিরোধিতার অধিকার তাহার নাগরিককে দিয়াছে, বাইশ বৎসর বয়সি দিশা রবির মামলার রায়ে এই কথা সেই দিন আর এক বার উচ্চারিত হইল। চুয়াত্তর বৎসর বয়সি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যাহা প্রতিষ্ঠিত নীতি হইবার কথা ছিল, ঘটনাচক্রে— কিংবা বলা ভাল, রাজনীতিচক্রে— তাহা এখন ক্ষণে ক্ষণে দেশদ্রোহ মামলার বিষয় হইয়া দাঁড়ায়, সুতরাং এই উচ্চারণ স্বস্তিদায়ক। টুলকিট হ্যান্ডলে তরুণী দিশা এমন কিছু বলে নাই কিংবা করে নাই, যাহাতে তাহাকে দেশের শত্রু হিসাবে গণ্য করা যাইতে পারে। নীতিটি পরিষ্কার: সরকার এবং দেশ/রাষ্ট্র এক নহে। সরকার অপেক্ষা দেশ কিংবা রাষ্ট্র গুণগত ও পরিমাণগত ভাবে আলাদা: দ্বিতীয়টিতে বিরোধিতার পরিসর প্রভূত। নির্বাচিত সরকারকে তাই বিরোধী পরিসরটির প্রতি কেবল সহিষ্ণু হইতে হয় না, দেশ বা রাষ্ট্রের অপর কণ্ঠ হিসাবে তাহাকে মান্যতা ও মর্যাদা দিতে হয়। বর্তমান সরকার নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিষয়টি গুলাইয়া দিতেছে, এবং নিজের বিরুদ্ধে সব রকম প্রতিবাদকে দেশের বিরুদ্ধতা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ হিসাবে প্রতিপন্ন করিবার জন্য উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে। বাস্তবিক, গত কয়েক বৎসরে ভারতের সমাজ ও রাজনীতি জীবনে ইহাই সর্বাপেক্ষা গুরুতর ক্ষতি।


মাননীয় বিচারক আরও একটি জরুরি কথা মনে করাইয়াছেন। প্রতিবাদ নাগরিকের অধিকার, এবং আন্তর্জাতিক শ্রোতৃমণ্ডলের প্রতি লক্ষ করিয়া কথা বলাও সেই অধিকারের অন্তর্গত। দেশের সরকার যদি কাহারও মতে কোনও ‘খারাপ’ কাজ করে, তবে কেহ বাড়িতে বসিয়া বন্ধুকে যেমন তাহা বলিতে পারেন, তেমনই সমাজমাধ্যমে তাহা আলোচনা করিতে পারেন— দুইটিই তাঁহার বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে ঘিরিয়া যে হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি হইয়াছে, দিশার বার্তা বিনিময়ের সহিত তাহার সামান্যতম সংযোগও পাওয়া যায় নাই: তবে কিসের ভিত্তিতে মেয়েটিকে গ্রেফতার করা হইয়াছিল?


ভীমা-কোরেগাঁও হইতে হাথরস হইতে টুলকিট, মোদী সরকারের দেশদ্রোহ প্রকল্প সাড়ম্বরে চলিতেছে। লক্ষণীয়, অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং রাজনৈতিক অসংবেদনশীলতার কারণে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ মনে করিতেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলাই অপরাধ, তাই ভারাভারা রাও হইতে দিশা রবি, জামিন পাইলেও, ইঁহারা সব সাক্ষাৎ অপরাধী। ইহা যদি প্রথম দুর্ভাগ্যের বিষয় হয়, দ্বিতীয় দুর্ভাগ্যটি চরিত্রে আরও মারাত্মক। দিশার জামিনের সংবাদে খুশি কিন্তু উদ্বিগ্ন এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিবাদী তরুণ বলিয়াছেন, ইহার পর একটু ‘বুঝিয়া-শুনিয়া’ চলিতে হইবে। এইখানেই সমস্যা। কোনও ‘অপরাধ’ না করিয়াও অ্যান্টি-ন্যাশনাল বা দেশদ্রোহী হিসাবে, অর্থাৎ ‘অপরাধী’ হিসাবে, সমাজে পরিচিত হইবার এই সুকঠিন বাস্তব, কিংবা গ্রেফতার হইবার সম্ভাবনা, ইহা কি স্বাভাবিক ভাবেই বাক্‌স্বাধীনতা বিষয়টিকে পাল্টাইয়া দিতেছে না? আরও এক বার বিরোধিতা করিবার আগে দিশার মতো তরুণতরুণীরা কি ভাবিয়া দেখিবেন না যে কী ঘটিতে পারে ইহার ফলে? স্বাভাবিক আত্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কি তাঁহারা করিবেন না? এই আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা অন্যায় নহে, বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু এইখানেই আসলে লুকাইয়া আছে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত পরাজয়। নরেন্দ্র মোদীর কর্তৃত্ববাদী অসহিষ্ণু সরকার ভারতকে পাল্টাইয়া দিবে, এমন ভাবিবার দিন আর নাই। ভারত আসলে পাল্টাইয়া গিয়াছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Constitution of India Independent Thinking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE