মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
শহিদ দিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছু হিসাব দিলেন। হিংসার হিসাব। জানালেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসায় তাঁর দলের যত জন কর্মী মারা গিয়েছেন, বিরোধী দলের নিহত কর্মীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। জানালেন, গোটা রাজ্যে হিংসা হয়েছে মাত্র তিন-চারটি জায়গায়। জানালেন, ২০০৮-এ শুধুমাত্র পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনই নিহত হয়েছিলেন ৩৯ জন— এ বছর কয়েকটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ঘটেছে মাত্র। কথাগুলির মধ্যে দু’টি বার্তা নিহিত। এক, এই ভোটের রাজনৈতিক হিংসার পরিমাপ নিয়ে রাজ্যের শীর্ষনেত্রী যথেষ্ট অবহিত; এবং দুই, সেই বাস্তবটি তিনি যথাসাধ্য উপেক্ষা করতে চান, এই ভয়ঙ্কর হিংসার উৎস ও সূত্রকে অস্বীকার করতে চান— কেননা স্বীকার করতে হলে তাঁর দিক থেকে অনেকটা আত্মস্খলন মেনে নিতে হয়। অথচ এই রাজ্যের সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা যে ভাবে দেশময় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। ‘ওদের নিহত আমাদের নিহত’-র এই অবাঞ্ছিত ও কুরুচিকর হিসাব দিয়ে প্রশাসক তাঁর ব্যর্থতা ঢাকতে পারেন না। বরং এ সব বলে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, রাজ্যের ক্ষতস্থানটি নিরাময়ের কোনও চেষ্টাই তিনি করবেন না, তার বদলে অন্যের উপর দোষচাপানো ও অন্যের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশই চলবে, চলতে থাকবে।
সভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন না, সেটা তাই বিশেষ লক্ষণীয়। তিনি জানেন যে, প্রতিটি হিংসার ঘটনা তাঁর দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে। গণতন্ত্রের ধারণাটি অব্যবহারে যতই লুপ্তপ্রায় হোক না কেন, ভোটের রাজনীতি এ ভাবে হিংসায় পর্যবসিত হলে মানুষের তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী এও জানেন যে, হিংসা কেবল শাসক ও বিরোধীর মধ্যে নয়, শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও বহু হিংসার জন্ম দিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসার যে স্রোত বয়েছিল, তার ক্ষতে প্রলেপ লাগাতেই তৈরি হয়েছিল ‘দিদিকে বলো’— মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের পরিসর নিশ্চিত করার চেষ্টা। তেমন কোনও প্রলেপের প্রয়াস এখনও পর্যন্ত শোনা যায়নি। তবে কেবল তো ভোট-হিংসা নয়, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ভোটের বাইরেও চিন্তিত— দুর্নীতির মাত্রাছাড়া অভিযোগ, এবং তার সঙ্গে আন্দোলনের অস্থিরতা নিয়ে। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ যতখানি অশান্ত হয়ে রয়েছে, তৃণমূল নেত্রী তা মাথায় রেখে কিছু বৃহত্তর আশ্বাসে পৌঁছনোর চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ভুলত্রুটি শুধরে রাজ্যকে স্বাভাবিকতার পথে ফেরানোর চেষ্টার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি বলেননি।
যা বলেছেন, তার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সদ্যগঠিত জোট ‘ইন্ডিয়া’-র কথা। অনুমান করা চলে যে, তিনি এই জোট নিয়ে আগ্রহী, অন্তত আপাতত। কিন্তু, জোট মানে তো কেবল দিল্লি দখলের অভিযান নয়— জোট মানে এই রাজ্যে কংগ্রেস ও বাম দলগুলির সঙ্গে সহাবস্থান, এক উদ্দেশ্যে লড়াই। তার প্রথম ধাপ, সহাবস্থানের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি। কংগ্রেস বা বাম দলের কর্মীরা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হবেন, এবং তাঁদের সঙ্গেই জোট করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন, তা হয় না। ফলে, জোট বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে আগ্রহ দেখিয়েছেন, রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা তার বিপরীতমুখী। এই অস্বীকার ও নিষ্ক্রিয়তা কোন রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে না হলেও সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবে দেখেছেন কি? রাজ্যে যদি রাজনৈতিক সুস্থতার দিকে হাঁটা না যায়, ‘মোদী যাক মোদী যাক’ আওয়াজ বেদম ফাঁকা শোনাবে না কি? যে গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষার কথা বলে তাঁরা বিরোধী জোট গড়ে তুলছেন, এই রাজ্যে সেই গণতন্ত্রের আব্রুর দায়িত্বটি তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। অথচ শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে শোনা বার্তায় তেমন কোনও স্বীকৃতি ধ্বনিত হল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy