Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Women Reservation Bill

ইতিহাস বনাম তাস

গত তিন দশকে বারংবার এই বিল আটকে গিয়েছে একটিই আপত্তিতে, মহিলা সংরক্ষণের মধ্যে অনগ্রসর সমাজের মহিলাদের আলাদা ভাবে সংরক্ষণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নে।

An image of PM Narendra Modi

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৪২
Share: Save:

মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটুকুই সংবাদ নয়। নতুন সংসদ উদ্বোধনের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন দেশ বিকশিত হতে চলেছে, এবং এই বিকাশের কাজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে হচ্ছে— এই সমগ্র ঘটনাকে ঐতিহাসিক বলে দাবি করছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। সংসদে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেছেন, ঈশ্বর সম্ভবত তাঁকেই এই মহৎ কাজের জন্য বেছে নিয়েছেন। সুতরাং এই মুহূর্তে মহিলা সংরক্ষণ বিলের বক্তব্যের সঙ্গে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন ও কী ভাবে বিলটি পরিবেশিত হল, সেই আলোচনা। অবহিত নাগরিক জানেন যে, মহিলা সংরক্ষণের বিষয়টি আদৌ নতুন নয়। গত চার দশক ধরে বারংবার এই বিল আনার চেষ্টা হয়েছে— বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাকালে, বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর শাসনপর্বে। মোদী তাঁর বক্তৃতায় পূর্বতন নেতাদের প্রয়াস উল্লেখও করেছেন, যদিও একই সঙ্গে তাঁর অমিত বিদ্রুপ এবং বক্রোক্তিতে মিশে থেকেছে এই প্রচ্ছন্ন দাবি যে শেষ পর্যন্ত তিনিই এ কাজ করতে পারছেন, বাকিরা অপারগ, ব্যর্থ। তাঁর এই বক্তব্য কেবল ভুল নয়, অন্যায়। কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধী যে বলেছেন তাঁদের আরব্ধ কাজ মোদী শেষ করলেন, সে দাবিতে তাই এক বিন্দু ভুল নেই।

এত দীর্ঘবিতর্কিত বিল নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কিসের? সরকার পক্ষের নিজেরই বক্তব্য, বিল পাশ হওয়ার পরও এই দশকের শেষের আগে তার প্রয়োগ সম্ভব নয়, যে-হেতু জনগণনার সঙ্গে বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত। বিরোধীরা অনেকেই এই বিলম্বিত প্রয়োগে অপ্রসন্ন— মহিলা সংরক্ষণ যখন আইন হিসাবে চালু হচ্ছেই, তা হলে আর অপেক্ষা কিসের। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র এমনকি এও বলেছেন যে, গোসংরক্ষণ চালু করার জন্য যদি গো-শুমারি না দরকার হয়, তবে এই ক্ষেত্রেও পরবর্তী জনগণনা জরুরি নয়। এখন থেকেই তো তা সরকারি নীতি হিসাবে চালু হোক, যেমন কোনও কোনও রাজ্যে ইতিমধ্যেই প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু এর পরও একটি বড় আপত্তি থাকে। যদি অপেক্ষাই করতে হয়, তা হলে এত তড়িঘড়ি সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বিলটি উত্থাপন করা হল কেন? প্রশ্নটি আলঙ্কারিক। হেতু অতি স্পষ্ট। জাতীয় নির্বাচন সমাসন্ন, তাই সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্যেই মহিলা সংরক্ষণের তাস খেলার এই তাড়া। কেউ বলতে পারেন, প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রে এ-হেন তাসক্রীড়া তো চলেই থাকে। বস্তুত, তাস খেলাটি কুরুচিকর হলেও বিস্ময়কর নয়: তাড়ার কারণে এত গুরুতর একটি বিষয়কে যথাযোগ্য গুরুত্ব না দেওয়ার প্রয়াসটি অত্যন্ত আপত্তিকর। গত নয় বছরে বহু দীর্ঘমেয়াদি ও দূরপ্রসারী গুরুত্বের বিষয় বিতর্কহীন ভাবে পাশ করিয়ে নেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিজেপি সরকার। এ বারও একই ঘটনা ঘটল।

গত তিন দশকে বারংবার এই বিল আটকে গিয়েছে একটিই আপত্তিতে, মহিলা সংরক্ষণের মধ্যে অনগ্রসর সমাজের মহিলাদের আলাদা ভাবে সংরক্ষণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নে। একাধিক বার সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো ওবিসি-প্রধান দলগুলি সংস্কারটির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বার কিন্তু সংসদে বিলটি ওঠার পর আশ্চর্য ঔদাসীন্য দেখা গেল তাদের মধ্যে। বরং কংগ্রেস নেতারা এ বার ‘সংরক্ষণের মধ্যে সংরক্ষণ’ নীতি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু যে বিতর্ক এ বিষয়ে প্রত্যাশিত ছিল, তা হয়নি। প্রসঙ্গত এই বিল নিয়ে বিজেপির মধ্যেও বহু দ্বিধা— পঞ্চাশের দশকে হিন্দু মহিলার সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে বাধাদানকারী হিন্দুত্ববাদীরাই যে দলের কান্ডারি। দুর্ভাগ্য যে মহিলা সংরক্ষণের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাটি গণতান্ত্রিক বিতর্কের পাশ কাটিয়ে এমন সঙ্কীর্ণ ও সুবিধাবাদী পদ্ধতিতে সংঘটিত হল। যা হতে পারত এক গৌরবমুহূর্ত, তাকে পরিণত করা হল দলীয় সুযোগসন্ধানের ক্লিন্নতায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy