নারদের মুখে রামায়ণ রচনার প্রস্তাব শুনে বাল্মীকি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন— রঘুপতির কীর্তিকথা তিনি শুনেছেন বটে, কিন্তু, ‘তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা,/ সকল ঘটনা তাঁর— ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।’ ভাষা ও ছন্দ কবিতায় বিধৃত নারদের উত্তরটি কেবল বহুচর্চিত নয়, অবিস্মরণীয়। আদিকবিকে তিনি বলেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ এই আশ্চর্য পঙ্ক্তিগুলি রবীন্দ্রনাথ কি আজ আর লিখতে পারতেন? কেবল অযোধ্যা এবং রামজন্মভূমির আধুনিক বৃত্তান্ত যে তাঁর চিত্তবৈকল্য ঘটাত, তা-ই নয়— দেশ ও দুনিয়া জুড়ে অহরহ ‘ফেক নিউজ়’ এবং ‘পোস্ট-ট্রুথ’ নামক দানবদের উপদ্রব দেখার পরে ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’ লিখতে তাঁর কলম সরত কি? সত্যের নামে, তথ্যের নামে, সংবাদের নামে চূড়ান্ত অতিরঞ্জন এবং নির্জলা মিথ্যার এই দিগ্বিজয় বোধ করি তাঁকেও বাক্যহারা করে দিত। রবীন্দ্রনাথের কাল তো কবেই বিগত হয়েছে, মাত্র কয়েক বছর আগেও সংবাদ-পুচ্ছধারী অসত্যের এমন বিপুল প্রসার দেখা বা শোনা তো যেতই না, ভাবাও যেত না। মিথ্যা সংবাদ নতুন নয়, নিছক গুজব থেকে শুরু করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুয়ো খবর রটনার বহু নজির ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে, কিন্তু প্রচার-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব এবং অভাবিতপূর্ব ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অনন্ত অফুরন্ত মিথ্যা ও অর্ধসত্য যে ভাবে প্রতিনিয়ত সংবাদের গোটা পরিসরটিকেই কলুষিত, বিস্রস্ত, বিনষ্ট করতে তৎপর, তার কোনও তুলনা ইতিহাসে মিলবে না। সংবাদ মূলত সত্য, সে-কথা বিষ্ণু দে-ও নিশ্চয়ই অস্বীকার করতেন না। যথাযথ তথ্য এবং তার যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণই সংবাদমাধ্যমের যথার্থ বনিয়াদ। অথচ, এখন তাকে আক্ষরিক অর্থেই নিরন্তর লড়াই করতে হয় মিথ্যার সঙ্গে, চার দিকে যে মিথ্যার ঝড় চলছে। না, চার দিকে নয়, দশ দিকে।
সঙ্কট যেখানে, লড়াইও সেখানেই। যথার্থ সত্যান্বেষী সংবাদমাধ্যমের লড়াই। ভরসা এই যে, কঠিনতম প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও সেই লড়াই হারিয়ে যায়নি, ফুরিয়ে যায়নি। এবং আশার কথা, সচেতন ও সুচেতন নাগরিক সেই সত্যসাধনায় সংবাদমাধ্যমের পাশে আছেন, যেমন বরাবর ছিলেন। গুণগ্রাহী পাঠকরা পাশে আছেন বলেই সংবাদপত্র সহস্র সমস্যার মধ্য দিয়ে আপন কর্তব্য সম্পাদন করে চলেছে। কিন্তু কেবল গুণগ্রাহী নন, তাঁরা একই সঙ্গে প্রখর সমালোচক, তাঁদের প্রখর দৃষ্টি সংবাদপত্রের উপর সতত নিবদ্ধ, ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দিতে তাঁরা অকুণ্ঠ। আর সেই নিরন্তর পরিস্রুতির কল্যাণেই সংবাদপত্র তার স্বধর্মে স্থিত থাকার প্রেরণা পায়, সহযোগিতাও পায়। চতুর্দিকে সংবাদের নামে যখন অজস্র অসত্য ও তথ্যবিকৃতির ছয়লাপ, মন্তব্য বা বিশ্লেষণের ছদ্মবেশে অন্যায় ও বিপজ্জনক নানা অভিসন্ধির ক্রিয়াকলাপ, তখন দায়িত্বশীল সংবাদপত্র কী ভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠক তথা জনসমাজের কাছে আপন বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রতি দিন প্রতিষ্ঠিত করে চলে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। দুনিয়া জুড়েই সুস্থ এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের পরিসর হিসাবে সংবাদপত্রের কদর গত কয়েক বছরে নতুন করে বেড়েছে, নানা সমীক্ষায় তার পরিচয় আছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যয়ী ভরসার কারণ আছে বইকি।
কিন্তু আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। যথার্থ সংবাদপত্রের পথ সুগম নয়, কস্মিন্কালেও সুগম ছিল না। ক্ষমতার মুখের উপর সত্য বলতে চাইলে পথ কুসুমাস্তীর্ণ হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আজ অপ্রিয় সত্যের প্রতি, এমনকি অস্বস্তিকর প্রশ্নের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতার ধারক এবং রাজনীতির চালকদের অসহিষ্ণুতা যে মাত্রায় পৌঁছেছে তার ফলে সংবাদপত্রের পথ কণ্টকাকীর্ণ বললে কিছুই বলা হবে না, ক্ষতবিক্ষত বললেও বিপদের রূপটি সম্যক বোঝা যাবে না, হয়তো বলা যেতে পারে সে-পথের যত্রতত্র ল্যান্ডমাইন প্রোথিত, যে কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এই সুকঠিন অভিযাত্রায় সত্যই একমাত্র আলোকবর্তিকা। সত্যের সন্ধানই সংবাদপত্রের স্বধর্ম, সত্যের প্রকাশই তার ব্রত। সেই সন্ধান কখনও সমাপ্ত হতে পারে না, ‘সম্পূর্ণ সত্য’ অনিবার্য ভাবে অধরা থেকে যায়। আদিকবির প্রতিধ্বনি করে সংবাদপত্রকে বলতে হয়, ‘নাহি জানি সমগ্র বারতা’। সে শুধু জানে, আজ, কাল, পরশু, মাস, বছর, শতাব্দী অতিক্রম করে তার বিরামহীন, অন্তহীন, ক্লান্তিহীন সত্যান্বেষণ জারি থাকবে। মহাকাল যে তার ললাটে লিখে দিয়েছেন সেই অমোঘ মন্ত্র: চরৈবেতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy