— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অতিমারি আর যুদ্ধের ধাক্কায় ২০২০ সাল থেকে আরও সাড়ে ষোলো কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গিয়েছেন, শুধুমাত্র এই বিবৃতিটির মধ্যে বাস্তব ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্রটি ধরা পড়ে না। সম্পূর্ণ ছবিটি হল, এই সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের কার্যত প্রত্যেকেই নিম্ন বা মধ্য-নিম্ন আয়ের দেশের বাসিন্দা। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর সদ্যপ্রকাশিত রিপোর্ট আ ওয়ার্ল্ড অব ডেট: আ গ্রোয়িং বার্ডন টু গ্লোবাল প্রসপ্যারিটি বলছে যে, এই দেশগুলি ডুবে রয়েছে দেনার দায়ে। অতিমারি, যুদ্ধ, প্রবল মূল্যবৃদ্ধি— একের পর এক ধাক্কায় তাদের দেনা বেড়েছে আড়েবহরে। গোটা দুনিয়ায় ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ এমন দেশে বাস করেন, যেখানে সরকার স্বাস্থ্য বা শিক্ষাখাতে যত টাকা ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় সরকারের ঋণ পরিশোধে। জার্মানি প্রতি বছর যত টাকা ঋণ পরিশোধ করে, তার দশ গুণ খরচ করে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে। অন্য দিকে, লেবাননে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে যা ব্যয় করা হয়, তার তিন গুণ টাকা যায় ঋণ পরিশোধ করতে। এর ফলে তৈরি হয় উন্নয়ন-ঘাটতি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। উন্নয়ন খাতে খরচ কাটছাঁট করা সরকারের পক্ষে সহজ— প্রথমত, সেই ঘাটতি সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে না, তার ফল ভয়ঙ্কর কিন্তু শ্লথ, দীর্ঘমেয়াদি; দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন খাতে ব্যয় হ্রাস করলেও সরকারের টুঁটি চেপে ধরার ক্ষমতা সাধারণ নাগরিকের নেই। কিন্তু, পাওনাদার অন্য বস্তু। ঋণখেলাপি হলে ঝামেলার শেষ নেই। ফলে, ঋণে ডুবে থাকা দেশগুলোর স্কুলে শিক্ষকের ব্যবস্থা হয়নি, হাসপাতালে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ বন্ধ থেকেছে। কোনও দেশে বরাদ্দ কমেছে কর্মসংস্থান যোজনায়, কোথাও টান পড়েছে গরিব মানুষের জন্য খাদ্য ভর্তুকিতে। প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দরিদ্র মানুষ।
গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে সব দেশই। কিন্তু, দরিদ্র দেশগুলি এমন প্রবল ভাবে বিপন্ন হল কেন? উত্তরটি সহজ— এই দেশগুলি দরিদ্র বলেই এদের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ ছিল কম। ফলে, এক বার ঋণের ফাঁদে পড়লে তা থেকে বেরিয়ে আসার, অথবা সেই অবস্থাতেও উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সামর্থ্য এই দেশগুলির নেই। ঋণের বোঝা বেসামাল হলে অর্থব্যবস্থা কতখানি বেহাল হতে পারে, তার দু’টি প্রকট উদাহরণ ভারতের দু’প্রান্তে রয়েছে— এক দিকে শ্রীলঙ্কা, অন্য দিকে পাকিস্তান। বাংলাদেশও খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। বিশ্ব দারিদ্রের অন্য কেন্দ্র আফ্রিকার অবস্থাও একই রকম। অর্থব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়লে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সমাজের সর্ব স্তরে— রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, মানুষের মধ্যে সহযোগিতার প্রবণতা কমে, সামাজিক আস্থা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়ন-ঘাটতি যে-হেতু এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়, এবং কোনও দেশের মধ্যেও যে-হেতু এই ঘাটতি সমবণ্টিত নয়, ফলে তা দীর্ঘমেয়াদি বৈষম্যের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এবং, বর্তমান বিশ্ব সাক্ষ্য দেবে যে, এই পরিস্থিতিতে একনায়কতন্ত্রী, কর্তৃত্ববাদী শাসকের পথ প্রশস্ত হয়। অর্থাৎ, যে দেশগুলি দেনার দায়ে বিপর্যস্ত, এই পরিস্থিতি শুধু সে দেশে মানবিক সঙ্কট তৈরি করছে না, তা বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্যও দুঃসংবাদ বহন করছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জ সমাধানের একটি পথ নির্দেশ করেছে— অন্তত কিছু দিনের জন্য ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখা। অনুন্নত দেশগুলির ঋণের বড় অংশ রয়েছে বিভিন্ন বৈশ্বিক অর্থ সংস্থায়, বা উন্নত দেশগুলির ঋণ প্রদানকারী সংস্থায়। মোট অঙ্কটি এমন কিছু নয় যে, কিছু দিনের জন্য সেই ঋণ পরিশোধ বন্ধ থাকলে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় তার ভয়ঙ্কর কোনও প্রভাব পড়বে। প্রশ্ন হল, এ পথে হাঁটার রাজনৈতিক সদিচ্ছা উন্নত দেশগুলির রাজনৈতিক নেতৃত্বের আছে কি? সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে জি২০-র বৈঠকে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে কি না, দরিদ্র দেশগুলি সে দিকে তাকিয়ে থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy