বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
গতানুগতিক, দিশাহীন, অপরিণামদর্শী— স্বাস্থ্য ও পুষ্টির নিরিখে এই তিনটে বিশেষণ দিয়ে চিহ্নিত করা যায় কেন্দ্রীয় বাজেটকে। প্রথমটির প্রমাণ অকারণ কার্পণ্য। স্বাস্থ্যই সম্পদ, এ কথা যেমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে, তেমন জাতির ক্ষেত্রেও সত্য। তাই উন্নয়নের সূচকে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিশেষ গুরুত্ব পায়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ ব্যয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহা যথা পূর্বং। স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ যৎসামান্য বেড়েছে (গত বাজেটের চাইতে ১.৭ শতাংশ) ঠিকই, তবে মূল্যস্ফীতির পিঁপড়ে লাভের চিনিটুকু খেয়ে গিয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার খুব কম করে ধরলেও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমেছে অন্তত এক শতাংশ। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭) সুপারিশ করেছিল যে জিডিপি-র অন্তত আড়াই শতাংশ ব্যয় করতে হবে স্বাস্থ্যে। কিন্তু বার্ষিক আর্থিক সমীক্ষাগুলি বার বার দেখিয়েছে, কোনও বছরই ব্যয় দু’শতাংশ ছাড়ায়নি (এই ব্যয়ের হিসাবে অবশ্য পানীয় জল ও শৌচনিকাশির খরচও ধরা রয়েছে)। এ বছরে স্বাস্থ্যে মোট বরাদ্দ (৮৭,৬৫৬ কোটি টাকা) সরকারের যে মনোভাবের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় আড়াই শতাংশের লক্ষ্যে পৌঁছনোর সম্ভাবনা কম। সরকার যে খরচ বাঁচাচ্ছে, তা পূরণ করতে হচ্ছে মানুষের পকেটের টাকায়— চিকিৎসার জন্য নাগরিকের ব্যয়ের হার অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি। নীতি আয়োগেরই একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতে অন্তত দশ কোটি মানুষ প্রতি বছর চিকিৎসার খরচ দিতে গিয়ে দারিদ্রে পতিত হন, ৪৭ শতাংশ পরিবারের কাছে চিকিৎসার খরচ ‘বিপজ্জনক’ (ক্যাটাসট্রফিক)। এই বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেট-বক্তৃতায় তিনটি ক্যানসারের ওষুধের শুল্ক মকুব করার কথা ঘোষণা করলে তা করুণ কৌতুক বলে মনে হতে বাধ্য।
উদ্বেগের বিষয় এই যে, পরিকাঠামো নির্মাণ এবং দক্ষ কর্মী প্রশিক্ষণের খাতে বরাদ্দ টাকা খরচ হচ্ছে না, তার জেরে বরাদ্দও কমছে। যেমন, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরির জন্য গত বাজেটে বরাদ্দ হয়েছিল সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা। ওই টাকায় জেলা হাসপাতালগুলিকে মেডিক্যাল কলেজ করা, মেডিক্যাল কলেজের সিট বৃদ্ধি, নার্সিং ও প্যারামেডিক্যাল কর্মী তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠানের উন্নতি, ইত্যাদি করার কথা ছিল। দেখা যাচ্ছে, খরচ হয়েছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা, এবং এ বছর বরাদ্দ হয়েছে বারোশো কোটি টাকা। তা হলে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি হবে কী করে? তার জন্য কি সরকার নির্ভর করবে কেবলমাত্র বেসরকারি ক্ষেত্রের উপরে, না কি অন্য কোনও পরিকল্পনা রয়েছে? তেমনই, নতুন ‘এমস’ হাসপাতাল তৈরি, ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরিষেবা, টেলি-মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার খাতে বরাদ্দ কমেছে। সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে দিল্লির ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’-এর একাধিক শাখা সারা দেশে খোলার কথা ছিল, বিভিন্ন দফতরে সংহতি তৈরির কথা ছিল। সেই খাতে বরাদ্দের খরচ হয়েছে অর্ধেক, এ বছর বরাদ্দ কমেছে। অতিমারির ভয়ানক অভিজ্ঞতার তিন বছরের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি থেকে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার নীতির এই হাল। গঙ্গায় ভাসানো কোভিড-মৃতদের দেহগুলিও সরকারি ব্যয়-বরাদ্দে দিশা আনতে পারল না।
শিশুপুষ্টির বরাদ্দ দেখলে বোঝা যায়, সরকার অপরিণামদর্শী শুধু নয়, অমানবিক। শিশু ও কিশোরীদের পুষ্টির একাধিক প্রকল্প সরকার এনেছে একটি ছাতার তলায়, ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘পোষণ ২’। গত বছর এই খাতে যা ধার্য ছিল (২০৫৫৪ কোটি টাকা) তার চাইতে বাড়তি খরচ হয়েছিল ৯৬৯ কোটি টাকা। এ বছরের বরাদ্দ কিন্তু গত বছরের বরাদ্দের চাইতে কেবল ৬৪৬ কোটি টাকা বেশি। চল্লিশ শতাংশেরও বেশি অপুষ্ট শিশুর দেশ পুষ্টিপ্রকল্পের বরাদ্দ ছাঁটছে। শীর্ণ, রুগ্ণ, খর্বিত-মেধা শিশুবাহিনী নিয়ে অমৃতকালের উদ্যাপন, এই যেন ভারতের নিয়তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy