Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2022

শক্তিরূপেণ

দুর্গার মহাস্নানের মতো উষ্ণ জল, পুকুরের জল, ভোরবেলার শিশিরের জল, ফুলের জল বা পুষ্পজল, সমুদ্রজল, সুগন্ধি জল, রত্নখচিত জল, তিলতেলযুক্ত জল ইত্যাদি নয় রকম জলে প্রথমেই নবপত্রিকার স্নান।

কল বউ স্নান।

কল বউ স্নান। — ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২২ ০৬:৪২
Share: Save:

নতুন পোশাক, সুবাসিত নতুন শাড়িতে, পিছলে পড়া আলোর বন্যায় আজ উত্তর, কাল দক্ষিণ কলকাতার প্রতিমাদর্শনের পরিক্রমা উৎসাহী মহলে এত দিনে অনেক দূর এগিয়েছে— পূজার ‘সূচনা’ হয়েছে, তার প্রায় এক সপ্তাহ হল। কাদের ঠাকুর ভাল, কাদের আলোকসজ্জা আর কাদের মণ্ডপ কাকে টেক্কা দিচ্ছে, তা নিয়ে তুফান তুঙ্গে। পঞ্জিকামতে গত কাল সায়ংকালে বেলগাছের নীচে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসও সম্পূর্ণ হয়েছে। বোধন মানে দেবীকে ঘুম থেকে জাগানো। শাস্ত্রমতে, আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস অবধি দেবদেবীদের শয়নকাল। ঘুম ভাঙিয়ে দেবীকে মাঝপথে তোলা হচ্ছে, তাই অকালবোধন। সেই জাগরণ বা বোধনের পর ঢাক-ঢোল কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে আজ সকালেই দেবীপুজোর শুরু। এই সূচনাকেই শাস্ত্রমতে বলে, নবপত্রিকাপ্রবেশ। শ্বেত অপরাজিতার লতা ও হলুদ রঙের সুতোয় বাঁধা ন’টা গাছ— কলা, ডালিম, ওলকচু, জয়ন্তী, অশোক, হলুদ, বেল, ধান, মানকচু। এই নয়টা গাছ, লতাপাতা বাংলার জলেজঙ্গলে অক্লেশে হয়ে থাকে। দুর্গা মূর্তির ডান পাশে নবপত্রিকার এই কলাগাছ স্বাভাবিক ভাবে নুইয়ে পড়ে। ফলে বাঙালি একে গণেশের বৌ বা কলাবৌ বলে। আদতে গণপতির সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক নেই। এই অযত্নলালিত উদ্ভিদগুলি সকলে দুর্গারই রূপ। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর অধিবাস, বোধনের পাশাপাশি নবপত্রিকারূপী দুর্গাকেও আবাহন করতে হয়। প্রতিটি গাছেই দেবীর অধিষ্ঠান— কলায় ব্রহ্মাণী, কচুতে কালী, হলুদগাছে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিবা, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মানকচুতে চামুণ্ডা ও ধানে লক্ষ্মী।

মহাষষ্ঠীর সকালে যাঁরা ভিড়াক্রান্ত গঙ্গার ঘাটে ঢাক-ঢোল, কাঁসর বাজাতে বাজাতে নবপত্রিকাকে স্নানে নিয়ে যান, তাঁরা পুরো কাজ সমাধা করেন না। পুরো কাজ কী? দুর্গার মহাস্নানের মতো উষ্ণ জল, পুকুরের জল, ভোরবেলার শিশিরের জল, ফুলের জল বা পুষ্পজল, সমুদ্রজল, সুগন্ধি জল, রত্নখচিত জল, তিলতেলযুক্ত জল ইত্যাদি নয় রকম জলে প্রথমেই নবপত্রিকার স্নান। প্রত্যেক স্নানের আলাদা মন্ত্র। পুকুর বা বাপীজলে স্নান করানোর সময় বলতে হবে ‘দুর্গারূপেণ সর্বত্র স্নানেন বিজয়ং কুরু’। শিশিরজলে ‘হরিদ্রেহররূপাসি শঙ্করস্য সদা প্রিয়া’। সুগন্ধিজলে নবপত্রিকাকে স্নান করানোর সময় বলতে হবে ‘ময়া ত্বং পূজিতা দুর্গে স্থিরা ভব হরপ্রিয়ে’। এই সহজ মন্ত্রগুলিই বুঝিয়ে দেয়, গণেশের লজ্জারুণ নববধূ নয়, দুর্গার সৃষ্টিস্থিতিবিনাশী শক্তিরূপেই নবপত্রিকা পূজিত হন। বাঙালির পুরোহিত দর্পণ পরিষ্কার জানাচ্ছে, “সপ্তমীর সকালে বাদ্যধ্বনি সহকারে বিল্বশাখা ও নবপত্রিকা লইয়া পূজালয়ে প্রবেশ করিবে।” মানে, বেলগাছের ডালটিই সব নয়। তার সঙ্গে এ দিন দুর্গারূপিণী নবপত্রিকারও পুজো। ব্যানারে, ফেস্টুনে, লিফলেটে যতই শক্তির আরাধনায় অমুক সঙ্ঘ লেখা থাকুক না কেন, স্মার্ত রঘুনন্দন এবং কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বাংলা দীর্ঘকাল সেই শক্তি-ঐতিহ্য ভুলেছে।

‘পূজাবাড়ির ভিক্ষা’ নামে বঙ্কিমচন্দ্রের এক সরস প্রবন্ধই এর প্রমাণ। শিষ্য গিয়ে দেখে, তার বৈষ্ণব গুরুদেব নবমী পুজোয় মাংসপ্রসাদ ভক্ষণে ব্যস্ত। সে নানা কথা বলে, ‘আমরা কৃষ্ণের উপাসক। শক্তির প্রসাদ খাইব কেন?’ গুরু তখন জিজ্ঞাসা করেন, শক্তি কী? শিষ্য বলে, দেবতার শক্তি, দেবতার স্ত্রী। যেমন, নারায়ণের শক্তি লক্ষ্মী, শিবের শক্তি দুর্গা, এই রকম। গুরু রেগে শিষ্যকে পাপিষ্ঠ বলেন। তার পর বুঝিয়ে দেন, ওই জলের ঘটিটা তোলো দেখি। শিষ্য ঘটি তুললে গুরু বলেন, জলভর্তি ওই জালাটা তোলো দেখি। শিষ্য নিজের শক্তি বুঝে সে প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। তখন গুরু বোঝান, তোমার ঘটি তোলার শক্তি আছে, জালা তোলার শক্তি নেই। বাপু, দেবতা আপন ক্ষমতার দ্বারা করণীয় কাজ নির্বাহ করেন, সেই ক্ষমতার নাম শক্তি। অগ্নির দাহ করার ক্ষমতাই তাঁর শক্তি, তার নাম স্বাহা। ইন্দ্র বৃষ্টি করেন, সেই শক্তির নাম ইন্দ্রাণী। গূঢ় শক্তিতত্ত্বের পাশাপাশি বৈষ্ণব গুরুর মাংসভক্ষণ, বৈষ্ণব-শাক্ত সাম্প্রদায়িক বিভেদ মোছা, এখানেই দুর্গা পুজো। অযত্নলালিত কলা, কচু, ঘেঁচু বাঙালি সম্প্রদায়নির্বিশেষে পুষ্টির জন্য খায়। ডালিম শক্তিবর্ধক ও রক্তবর্ধক। জয়ন্তী এবং অশোক আয়ুর্বেদের মহৌষধ। মণ্ডপে মণ্ডপে তাই দুর্গার আলো-ঝলমল মহিষাসুরমর্দিনী রূপটি দেখলে বা কলাবৌ নিয়ে ঠাট্টা করলে চলবে না, সপ্তমীর দিনে আজ বাংলার শক্তিরূপিণী উদ্ভিজ্জ প্রকৃতিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2022 kola bou snan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy