গালিলেয়ো গালিলেইকে নিয়ে বের্টোল্ট ব্রেখটের লেখা বিখ্যাত নাটকের সংলাপ আজ মনে পড়তে পারে আরও বেশি করে। “দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে বীর নেই,” শিষ্যের এই আক্ষেপে স্থিতপ্রজ্ঞ বিজ্ঞানী বলেছিলেন, “দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়।” আজকের ভারতে এলে তিনি হয়তো সে কথা আরও একটু পাল্টে বলতেন, অতি বড় দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে অতি বড় দুর্বৃত্তকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়। গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে আরও দুই অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পেল সম্প্রতি, শীর্ষ আদালত-সহ নানা আদালতের রায়ে আগেই জামিনে মুক্ত আট জনেরও বেশি। সব মিলিয়ে গৌরীর হত্যা ও ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত সতেরো জনের মধ্যে এগারো জনই এখন কারাগারের বাইরে— মুক্ত। বিচারপ্রক্রিয়ার পথেই এই মুক্তি, এ কথা মেনে নিলেও দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় এদের ঘিরে উচ্ছ্বাসের রভস, ঢাকঢোল পিটিয়ে অভ্যর্থনা, ফুলমালায় বরণ। আজকের ভারতে, শাসক ও তার সমর্থকদের পেশি-ফোলানো উগ্র হিন্দুত্ববাদের রবরবায় বারংবার চোখের সামনে এই জিনিস দেখাটা নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, হত্যাকাণ্ডে জড়িতেরা পাচ্ছে বীরের সম্মান, নায়কোচিত সংবর্ধনা। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের নিয়ে কদর্য মাতামাতিও জনস্মৃতিতে তরতাজা। অবশ্য যারা নাথুরাম গডসে-কে নায়ক জ্ঞান করে, তাদের কাছে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়।
খুন, গণধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধে অভিযুক্তদের প্রতি ন্যূনতম সহিষ্ণুতাও যেখানে প্রশ্নের মুখে পড়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে উচ্ছ্বাসের কদর্য উৎসব। কোন সভ্য দেশ ও সমাজে এ জিনিস সম্ভব, সেই বিচার ও বিবেকবোধও এখন এই দেশ থেকে বিলুপ্ত। গৌরী লঙ্কেশ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অনবরত লিখতেন, পথে আন্দোলনে নামতেন, এই ছিল তাঁর ‘অপরাধ’; সুতরাং তাঁকে বাড়ির সামনে এসে বাইক থেকে গুলি করে পালিয়ে যাওয়া চলে— তা বীরের কাজ। বিলকিস বানোর কথা না-ই বা বলা গেল, নামে ও ধর্মপরিচয়েই তাঁর অপরাধ নিহিত। ভারত জুড়ে সঙ্ঘপন্থী অজস্র সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকদের এমনটাই বিশ্বাস: ২০১৪-উত্তর ভারত শুধুুই হিন্দুর ভারত, ভিনধর্মী মাত্রেই বহিরাগত, কেউ বিরুদ্ধস্বর শাণালেই প্রত্যাঘাত নিয়মসিদ্ধ। এই ‘নিয়ম’টি শাসনতন্ত্রে লেখা নেই, কিন্তু গত দশ বছরে নাগপুরের গুরুরা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে ছোট-বড় নেতারাও কখনও মৌনের সম্মতিক্রমে, কখনও প্রকাশ্য ঘোষণায় এই অভিযুক্তদের বীরের সম্মান দিয়ে সেই নিয়মটি তৈরি করে দিয়েছেন। দুর্বৃত্তদের মিলেছে পুরস্কার: জমি, চাকরি, ব্যবসার সুযোগ, ভোটের টিকিটও।
গৌরী লঙ্কেশের হত্যায় অভিযুক্তদেরও পুরস্কারে ভরিয়ে দেওয়া হবে, এ আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে পার্থিব পুরস্কার গৌণ, আসল পুরস্কারটি দিয়েই রেখেছে আজকের শাসক: বিচার তার পথে মন্দমন্থরে চলুক, সমাজের চোখে যাতে এদের কোনও দণ্ডবিধান না হয় সেই পথটি ক্রমেই সুগম ও সুপ্রশস্ত করে। এই রাষ্ট্রীয় কৌশলটির দু’টি অভিমুখ। এক দিকে ইউএপিএ-র মতো কঠোরতম আইনের বলি হয়ে বছরের পর বছর বিনা বিচারে ও বিনা জামিনে কারাগারে থেকে যাবেন উমর খালিদরা, অপ্রমাণিত অভিযোগে দশ বছর জেলবন্দি থেকে শেষে মুক্তি পেয়েও অসুস্থ হয়ে মারা যাবেন জি এন সাইবাবার মতো অধ্যাপকেরা; অন্য দিকে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বীরের সম্মান পাবে গোধরা হাথরস উন্নাও থেকে শুরু করে কর্নাটকে গৌরী লঙ্কেশ-কাণ্ডে অভিযুক্তেরা। মনে রাখা দরকার, জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর নাচানাচি তো পরের কথা, বিলকিস বানোর গণধর্ষণে অভিযুক্তরা যে দিন বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিল, খাস আদালতেই বয়ে গিয়েছিল সমর্থকদের সহানুভূতির স্রোত, বলা হয়েছিল এ আসলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। গৌরী-হত্যায় অভিযুক্তদের বীরের সম্মান দিয়ে ভারত সেই ‘ট্রাডিশন’টি বজায় রাখল। সত্য সেলুকাস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy