যে বর্ণাঢ্য উৎসবময়তায় গতকাল, ২৬ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়ে গেল ২০২৪-এর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্স, তা বোধ হয় একমাত্র প্যারিস তথা ফ্রান্সই ভাবতে পারে। স্টেডিয়ামের মধ্যে উদ্বোধন-অনুষ্ঠানের চিরাচরিত রীতি পেরিয়ে তাকে বাইরে, প্রকৃতির মধ্যে, আরও বেশি মানুষের মধ্যে নিয়ে আসার ভাবনায় যত না পরম্পরা ভঙ্গের স্পর্ধা, তারও বেশি রয়েছে তাকে মানুষের দরবারে প্রসারিত ও উপনীত করার ব্রত। তার পিছনে নিশ্চয়ই কাজ করেছে এই ভাবনা: খেলা তো স্রেফ খেলা নয়, শুধু মাঠ-ময়দান-স্টেডিয়ামে গণ্ডিবদ্ধ আবেগ নয়, তার স্বতঃস্ফূর্তি অবারিত গণপরিসরে। তাই সারা বিশ্ব দেখল, স্যেন নদীর পাড়ে, বিকেলের প্যারিসের শেষ আলোর রেশ ধরে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল অলিম্পিক্সের মশাল, বিশ্বখ্যাত গায়কেরা গাইলেন গান, নদীর বুকে সুদৃশ্য নৌকায় দেখা দিলেন এক-একটি দেশের প্রতিযোগী খেলোয়াড়রা— এ বারের ছকভাঙা অলিম্পিক প্যারেড। অনেকটা সময় জুড়ে বৃষ্টি হল, দর্শক ও অ্যাথলিটদের অসুবিধাও হল, একই সময়ে নানা জায়গায় নানা রকম অনুষ্ঠান হওয়ায় মনোযোগে বিঘ্নও ঘটল হয়তো, তবু এই সব পেরিয়ে জেগে রইল খেলা ও জনপরিসরের এই প্যারিসীয় সেতুবন্ধন।
বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমী মাত্রেই জানেন অলিম্পিক্সের গুরুত্ব। খেলার ছোট-বড় হয় না, জনপ্রিয়তা ও প্রচারের তারতম্যে অনেক ক্ষেত্রে কোনও খেলা ‘জাতে ওঠে’, কোনওটি থেকে যায় অপরিচিত। অলিম্পিক্সের গুরুত্ব এখানেই: খেলা যে কত রকম হতে পারে, এক-একটি দেশে কত খেলোয়াড় সারা জীবন মগ্ন এক-একটি খেলার অভ্যাস ও অনুশীলন নিয়ে— অলিম্পিক্স তাঁদের এক ছাদের তলায় এনে স্বীকৃতি ও সম্মাননা দেয়। এই জন্যই তার এত গৌরব, এ কারণেই প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বপ্ন অলিম্পিয়ান হওয়ার। পদক জয় তো নিঃসন্দেহে স্বপ্নপূরণ, অলিম্পিক্সে যোগ দিতে পারাই যে কোনও ক্রীড়াবিদের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’। বহু খেলারই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা আছে, তা নিয়ে ভক্তদের উন্মাদনাও আছে, কিন্তু প্রতি চার বছর পর এক-একটি দেশে ও শহরে হওয়া এই যে প্রতিযোগিতাটি, তার তুলনা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই এর আয়োজক হতে পারাও অতি সম্মানের। তার চ্যালেঞ্জও বিরাট: পনেরো দিন ধরে, প্রায় সাড়ে দশ হাজার অ্যাথলিট অংশগ্রহণ করবেন ৩২টি খেলার ৩২৯টি ইভেন্টে— এই সব কিছুর নিখুঁত ব্যবস্থাপনা, সঙ্গে নানা ‘অলিম্পিক ভিলেজ’ তৈরি করে খেলোয়াড় ও সাপোর্ট স্টাফদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, এ এক মহা কর্মযজ্ঞ।
প্রতিটি আয়োজক দেশই চায় এই যজ্ঞ চরিতার্থ হোক, আগের সব আয়োজন ছাপিয়ে যাক তার ব্যবস্থাপনা; মুকুটে যুক্ত হোক নতুন পালক, যা একান্ত ভাবে তারই। প্যারিস অলিম্পিক্স সগর্বে প্রচার করেছে, এই প্রথম অ্যাথলিটদের মধ্যে লিঙ্গসাম্য প্রায় ছোঁয়া গিয়েছে, পুরুষ অ্যাথলিটদের একেবারে না হলেও খুব কাছাকাছিই নারী অ্যাথলিটদের সংখ্যা। রয়েছেন ভিন্ন যৌনরুচির এবং রূপান্তরকামী অ্যাথলিটরা, দেশের পতাকার সঙ্গে যেন পতপত করে ওড়ে এই ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতা-নিশানও, প্যারিস তা নিশ্চিত করছে। নৌকা-প্যারেডে ফ্রান্স যেমন আয়োজক হিসাবে সবার শেষে এসেছে, তেমনই একেবারে শুরুতে এগিয়ে দিয়েছে অলিম্পিক্সের জন্মভূমি গ্রিসকে, এবং তার পরেই স্থান দিয়েছে বিশ্বের শরণার্থীদের নিয়ে গড়া অ্যাথলিট-দল ‘রিফিউজি অলিম্পিক টিম’কে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও বেলারুস বিশ্ব স্তরে ‘দণ্ডিত’, তা বলে তাদের অ্যাথলিটরা নন: এই দু’টি দেশের অ্যাথলিটরা ‘নিরপেক্ষ’ হিসাবে যোগ দিয়েছেন প্যারিসে। আছেন প্যালেস্টাইনের অ্যাথলিটরা। দেশের মাটিতে হয়তো চলছে যুদ্ধ, গৃহযুুদ্ধ-পরিস্থিতি, খরা বন্যা ভূমিকম্প ঘূর্ণিঝড়, ধর্ম ও জাতপাত নিয়ে লড়াই— সব কিছুর পরেও প্যারিসে এসেছেন নানা দেশের ক্রীড়াবিদরা। মূলগত ভাবে হয়তো খেলার জন্যই, কিন্তু কেবল খেলার জন্য নয়: সারা পৃথিবীর সামনে নিজের দেশ আর নিজেকেও প্রমাণ করতে। অলিম্পিক্স সেই মিলনভূমি যেখানে ষাটোর্ধ্ব অ্যাথলিটও উন্মুখ একুয়েস্ট্রিয়ান ইভেন্টে নামতে, বছর এগারোর স্কেটবোর্ডিং অ্যাথলিটের চেয়ে তাঁর উত্তেজনা ও একাগ্রতা কোনও অংশে কম নয়। ১১৭ জনের ভারতীয় অ্যাথলিট-দলও বহন করছেন সারা দেশের স্বপ্ন, মনে রাখা দরকার এঁদের মধ্যে ৭২ জনের এটাই প্রথম অলিম্পিক-অভিজ্ঞতা। অলিম্পিক্সের সৌন্দর্য আর মাহাত্ম্যও এটাই: জাতি ধর্ম বয়স সব পেরিয়ে, ‘খেলা’র ছলে জীবনের জয়গান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy