Advertisement
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
SEBI

সংশয়ের কালো ছায়া

লগ্নি তথা মূলধনের বাজার প্রবল ভাবে বিশ্বাস-নির্ভর, সেই বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে ওই বাজারের গোটা কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমগ্র অর্থনীতি।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৫২
Share: Save:

সিজ়ারের স্ত্রীকে সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকতেই হবে— এই প্রাচীন এবং বহুলপ্রচলিত নীতিবাক্যে নিহিত পিতৃতান্ত্রিক অনুশাসনটি আজ কেবল অরুচিকর নয়, সপাটে পরিত্যাজ্য। কিন্তু ওই বিশেষ অনুষঙ্গটিকে অতিক্রম করে অন্য অর্থে, অন্যতর নৈতিকতার মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করলে প্রাচীন প্রবচনটি আজকের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পক্ষে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই নৈতিকতার পিছনে আছে প্রশাসনের স্বচ্ছতার শর্ত। যেমন রাজনৈতিক প্রশাসনের, তেমনই অর্থনৈতিক প্রশাসনেরও। বিশেষত লগ্নির বাজার নিয়ন্ত্রণের ভার যাঁদের হাতে, তাঁদের সততা সম্পর্কে যদি জনমনে সংশয় তৈরি হয়, তবে তা বিপুল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার কারণ, লগ্নি তথা মূলধনের বাজার প্রবল ভাবে বিশ্বাস-নির্ভর, সেই বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে ওই বাজারের গোটা কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমগ্র অর্থনীতি।

ভারতের শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রণের ভারপ্রাপ্ত সেবি-র কর্ণধার সম্পর্কে আমেরিকান সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর আনা অভিযোগের পরম্পরা এই কারণেই বড় রকমের দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। গত বছরের গোড়ায় এই সংস্থাটি ভারতের একটি অতিকায় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বেনিয়মের অভিযোগ আনার পরে সেবি সেই বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। সেবি তার কাজ যথাযথ ভাবে করছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সংশয়ের কথা ইতিমধ্যে শোনা গিয়েছিল। অভিযুক্ত গোষ্ঠীটির সঙ্গে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদের বহুচর্চিত সুসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংশয়ের তাৎপর্য সহজবোধ্য। এই প্রেক্ষাপটেই গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত হয় হিন্ডেনবার্গ-এর নতুন অভিযোগ: সেবির চেয়ারপার্সন এবং তাঁর স্বামী এমন একটি ‘অফশোর ফান্ড’ অর্থাৎ আন্তর্জাতিক লগ্নি তহবিলে টাকা ঢেলেছেন যার সঙ্গে ওই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির সংযোগ আছে। অতঃপর স্বভাবতই এই প্রশ্ন আরও জোরদার হয়ে ওঠে যে, সেবির কর্ণধারের ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক স্বার্থও কি গোটা ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে?

সেবি এবং তার চেয়ারপার্সন তথা তাঁদের স্বপক্ষ থেকে অভিযোগগুলিকে সম্পূর্ণ অসত্য এবং অপপ্রচার বলে নাকচ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নিজে লগ্নির বাজারে সক্রিয়, অতএব অপপ্রচারের পিছনে তার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকাও সম্ভব। স্পষ্টতই, সমগ্র বিষয়টি সম্পর্কে বিশদ অনুসন্ধান জরুরি। প্রশ্ন হল, লগ্নি বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বোচ্চ আধিকারিকের সম্পর্কেই যখন অভিযোগ, তখন সেই অনুসন্ধান কে করবে? এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবি মেনে নিলে সেটা কেবল অর্থনীতির স্বাস্থ্যের অনুকূল হত না, শাসকদের মর্যাদা এবং বিশ্বাসযোগ্যতারও অনুকূল হত। ‘সাঙাততন্ত্র’ নামক বস্তুটির কালো ছায়া তাঁদের সিংহাসনের উপর প্রবল আকারে বিরাজমান বলেই সেই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের পরিচালকরা একান্ত বাধ্য না হলে সঙ্গত কাজ করেন না, যে কোনও প্রশ্ন বা আপত্তিকেই শত্রুতা হিসাবে গণ্য করেন ও উড়িয়ে দিতে চান। সুতরাং, আশঙ্কা হয়, সেবির কর্ণধার ও তাঁর স্বামীকে সংশয়ের ঊর্ধ্বে রাখার যথার্থ কোনও উদ্যোগ দেখা যাবে না। যস্মিন্ রাষ্ট্রে যদাচার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE