ভারতের মতো দেশে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ‘অসাম্য’ ইতিপূর্বে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বহুআলোচিত। সেই অসাম্যেরই এক নবরূপ প্রকট হয়ে উঠল সাম্প্রতিক এক জাতীয় সমীক্ষায়। দেখা গেল, জাত, পেশা এবং উষ্ণায়নজনিত ক্রমবর্ধমান উত্তাপের পারস্পরিক সম্পর্কটি বড় নিবিড়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট বেঙ্গালুরুর সহযোগী অধ্যাপক অর্পিত শাহ এবং তাঁর সহযোগীরা ২০১৯ এবং ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত পর্বটিতে শ্রমিকদের কাজের সময় কতখানি উত্তাপের সম্মুখীন হতে হয়, তার পর্যালোচনার জন্য পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে-র তথ্যের সঙ্গে মিলিয়েছেন আবহাওয়ার পরিসংখ্যান। জানা গিয়েছে, জাতভিত্তিক জীবিকা বিভাজনের কারণে তফসিলি জাতি, জনজাতি, এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের প্রতি দিন কাজের সময় অনেক বেশি উত্তাপ সহ্য করতে হয়। কারণ, সাধারণ শ্রেণির মানুষরা যেখানে গড়ে মোট শ্রম-ঘণ্টার ২৮ শতাংশ বাইরের কাজে ব্যয় করেন, সেখানে তফসিলি জনজাতিভুক্তদের ব্যয় করতে হয় মোট শ্রমঘণ্টার ৪৩-৪৯ শতাংশ। অসাম্যের এই নতুন দিকের নাম সমীক্ষকরা দিয়েছেন ‘থার্মাল ইনজাস্টিস’, উষ্ণতাজনিত অ-ন্যায়।
নামকরণটি যথার্থ, বিশেষত বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট হয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের কল্যাণে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্রতি বছর এক অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলে আগামী বছরগুলিতেও এই উষ্ণতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। সুতরাং, নিশ্চিত ভাবেই উষ্ণতাজনিত অসাম্যও স্বল্পস্থায়ী নয়, বরং প্রান্তিক মানুষের পেশাগত দুর্দশাকে দীর্ঘমেয়াদে আরও বৃদ্ধি করতে চলেছে। অবশ্য উষ্ণতাজনিত অ-ন্যায় শুধুমাত্র পেশাগত ক্ষেত্রেই নয়, জাতপাতদীর্ণ ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ইতিপূর্বে অন্য ভাবেও দেখা গিয়েছে। পানীয় জলের ক্ষেত্রে জাত বিভাজন বহু প্রাচীন। সমীক্ষায় প্রকাশ, দরিদ্র ও প্রান্তিক ঘরের মেয়েদের জলের সন্ধানে প্রত্যহ যত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। এই বছরের গ্রীষ্মে দেড় মাসেরও অধিক সময় নিদারুণ জলকষ্টে ভুগেছে কর্নাটক। অভিযোগ উঠেছিল, মল্লিগেরে নামক গ্রামটিতে জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন শুধুমাত্র গ্রামটি দলিত অধ্যুষিত হওয়ার কারণে।
আশ্চর্য এটাই যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই আইন করে জাতের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ হয়। ভারতীয় সংবিধান সকলের সমান অধিকারকে দৃঢ় ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাকে মান্যতা দিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে, জীবিকাক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তা সত্ত্বেও, বৈষম্য নিশ্চিহ্ন হয়নি। আগামী দিনে বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত পরিবর্তনগুলি এর সঙ্গে যুক্ত হলে অসাম্য আরও গভীরতর হবে। তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে নিজ ঘরকে শীতল করার ব্যবস্থা যাঁরা করতে পারবেন না, রাতের ঘুমটুকুও তাঁদের অধরা থাকবে। চল্লিশ পেরোনো গরমে মাঠে, রাস্তায়, খোলা চত্বরে কঠোর কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতে গিয়ে তাপজনিত অসুস্থতার শিকার হবেন তাঁরা আরও বেশি। ঘটবে প্রাণহানিও। তদুপরি, তৃষ্ণা মেটানোর পর্যাপ্ত জলের অধিকারটুকুও ক্রমেই হারাবেন তাঁরা। ভারতের নীতিনির্ধারকরা সেই দিন মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy