Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
CAA

বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ

২০২১ সালের অনুমান অনুসারে, এই রাজ্যে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি নাগরিক মুসলমান। আটটি জেলায় জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি মুসলমান।

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২২ ০৪:৫৫
Share: Save:

এক বছর পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এলেন, দেখলেন, এবং নয়া নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, ২০১৯ সালে সংসদে যে আইন পাশ হওয়ার আড়াই বছর পরেও তার বিধি প্রস্তুত হয়নি, রাজনৈতিক অপব্যবহার ছাড়া তার আর কি কিছুমাত্র প্রয়োগ আছে? উত্তরটি জানা। কিন্তু, এক বছর পরে পশ্চিমবঙ্গে এসে সেই নাগরিকত্ব আইনের অস্ত্রটিই তাঁকে প্রয়োগ করতে হল কেন? এই প্রশ্নের প্রাথমিক উত্তর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বেহাল সংগঠনে। বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হওয়ার পরবর্তী এক বছর দলটির রাজ্য শাখা হরেক অন্তর্দ্বন্দ্বের, দলত্যাগের সাক্ষী থেকেছে। মতুয়া ভোটব্যাঙ্কেও ভাঙন ধরার লক্ষণ স্পষ্ট। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যদি গত বারের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তবে তার জন্য যে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লাইন প্রয়োজন, অমিত শাহ বিলক্ষণ জানেন। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির যে দাবি দলের রাজ্য স্তরের নেতারা ইতিউতি পেশ করছিলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তাতে সমর্থন নেই, জানিয়েছেন শাহ। সম্ভবত বাংলার মাটিতে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করার ফল বিপরীত হতে পারে, এই কথাটি অনুমান করেই এই সিদ্ধান্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্বণ্টনমুখী জনবাদী রাজনীতির সামনে যে শাসনহীনতার অভিযোগও পায়ের নীচে তেমন মাটি পাবে না, সেই কথাটিও এত দিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে। অতএব, পড়ে থাকে শুধুই নাগরিকত্ব আইনের অস্ত্রটি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই অস্ত্র প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি।

কোভিড মিটলেই রাজ্যে নয়া নাগরিকত্ব আইন জারি হবে, এই কথাটির অর্থ কী? পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কথাটির তাৎপর্যই বা কী? চরিত্রগত ভাবে সংবিধানবিরোধী এই আইনটির প্রকৃত উদ্দেশ্য নাগরিকত্বের প্রশ্নে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রভেদ করা। এই আইনের অবস্থানটি নাগপুরের রাজনৈতিক দর্শনের পন্থী— সাভারকর থেকে গোলওয়ালকর, হিন্দুত্ববাদের প্রত্যেক তাত্ত্বিকই কোনও না কোনও ভাষায় মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছেন। নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি সেই নীতির প্রায়োগিক রূপ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আগত মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা শরণার্থী, এমন একটি অলীক বাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত, সেই প্রশ্নের সদুত্তর আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকার দেয়নি। কিন্তু সেই অনুপ্রবেশের বাহানাতেই জনজীবনে কী তাণ্ডব সৃষ্টি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত অসম। অমিত শাহের অনতিপ্রচ্ছন্ন হুমকির একটিই অর্থ হয়— তাঁরা বাংলায় অসমের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি চান।

২০২১ সালের অনুমান অনুসারে, এই রাজ্যে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি নাগরিক মুসলমান। আটটি জেলায় জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি মুসলমান। ফলে, এই রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জির জোড়া অস্ত্র প্রয়োগ করার অর্থ, রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ ঘোষণা। তার বিরোধিতা করার জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা বিরোধী হওয়ার প্রয়োজন নেই— শুধুমাত্র বাঙালি পরিচয়টিই যথেষ্ট। মুসলমানদের বাদ দিয়ে যে বাংলা নয়, হতে পারে না, এই কথাটি যত বার প্রয়োজন, বলতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি যে, অসমে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে যাঁদের বিপন্ন করা হয়েছে, তাঁদের সিংহভাগ বাঙালি, এবং অনেকেই ধর্মে হিন্দু। দিল্লির সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও হিন্দুত্ববাদীদের বাঙালি-বিরোধী সুরটি স্পষ্ট। কেউ বলতেই পারেন যে, অমিত শাহ এক অর্থে সমগ্র বাংলার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে গেলেন।

অন্য বিষয়গুলি:

CAA Bengalis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy