E-Paper

মানবজমিন?

প্রতিনিয়ত ‘সম্ভাবনা আছে’ বলে পরিতৃপ্ত বোধ করে চলার মধ্যে এক ধরনের মানসিকতার পরিচয় মেলে, যা স্বাস্থ্যকর নয়, কার্যকরও নয়।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:৩৪
Share
Save

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র নেতা, সমর্থক এবং অনুরাগীরা অনেকেই দলের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনের সমাপ্তি উপলক্ষে গত মঙ্গলবার আয়োজিত প্রকাশ্য জনসভায় লোকসমাগমের বহর দেখে পুলকিত বোধ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন ২০১১ সালের পরে এমন ‘সমর্থন’ পাওয়া যায়নি, এই ঐতিহাসিক সম্মেলন রাজ্য রাজনীতির মোড় ঘোরানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সম্ভাবনা উৎকৃষ্ট বস্তু। তবে কিনা, প্রতিনিয়ত ‘সম্ভাবনা আছে’ বলে পরিতৃপ্ত বোধ করে চলার মধ্যে এক ধরনের মানসিকতার পরিচয় মেলে, যা স্বাস্থ্যকর নয়, কার্যকরও নয়। বিশেষত, ডানকুনির ফুটবল ময়দান উপচে পড়তে দেখে যদি দলনেতারা সেই সম্ভাবনা দর্শন করেন। ভিড়ের মাত্রা দিয়ে এই বঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থনের মাপ নেওয়া যে সুবিবেচনার পরিচয় নয়, সে-কথা সিপিআইএমের নেতারা নিশ্চয়ই বিলক্ষণ জানেন। তা সত্ত্বেও যে তাঁরা ভিড় দেখে উল্লসিত আশাবাদের ফানুস ওড়াতে চেয়েছেন, সেটা বিচক্ষণ নাগরিকের মনে যা সৃষ্টি করতে পারে তার নাম করুণ রস।

বলা বাহুল্য, এই করুণ রসের প্রকৃত উৎসটি নিহিত আছে রাজ্যের (এখনও) প্রধান বামপন্থী দলের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায়— জনসমর্থনের পুঁজি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলার অভিজ্ঞতা। রাজ্য সম্মেলনে দলনেতারা এই দুরবস্থার সত্য স্বীকার করেছেন, এমনকি ‘আমাদের ত্রুটিগুলো’ খুঁজে বার করার কথাও সাফ সাফ জানিয়েছেন। ‘জনগণ ভুল করছেন, তাঁদের বোঝাতে হবে’ থেকে ‘আমরা ভুল করেছি, আমাদের বুঝতে হবে’— এই স্বীকৃতিতে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ বললে বোধ করি রেড বুক অশুদ্ধ হবে না! এবং, কেবল মেহনতি মানুষের কাছে যাওয়ার ফাটা রেকর্ড চালিয়েই এ-বার ক্ষান্ত হননি বাম নেতারা, ‘মানবজমিন’ আবাদ করার দেশজ বাণী উচ্চারণ করে জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনেই তাঁদের তৎপরতার অবসান হয়নি, তাঁরা জনগণের মন পাওয়ার জন্য অনেক দূর এগিয়ে খেলেছেন। ডানকুনির ময়দানে দাঁড়িয়ে কেউ বিরাট কোহলির ‘ক্লাস’-এর উপমা দিয়ে নিজেদের ‘শ্রেণি-ভিত্তি’র কাছে ফিরে যাওয়ার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছেন, কেউ বা পঞ্চায়েত পুরসভা ধরে ধরে মানুষের কাছে যাওয়ার নাম দিয়েছেন ‘ম্যান মার্কিং’! শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শ ও কর্মপন্থার এমন ভাষ্য শুনলে দলের অতীত যুগের নেতারা হয়তো ভিরমি খেতেন, কিন্তু এই বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর উপমাগুলিই বুঝিয়ে দেয়, পলাতক ভোটারদের ফিরিয়ে আনার জন্য বাম নেতারা মরিয়া।

সমস্যা ঠিক সেখানেই। তাঁরা মানুষকে দেখছেন নিছক ভোটদাতা হিসাবে। এ বিষয়ে তাঁরা ব্যতিক্রম নন। রাজনৈতিক দলগুলি মানুষকে ভোটার হিসাবেই দেখে। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের পক্ষে সেই গতানুগতিকতা কেবল নিষ্ফল নয়, আত্মঘাতী হতে বাধ্য। ভোটের ময়দানে তাঁরা এখন ধর্তব্যের মধ্যেই পড়েন না। এই কঠোর ‘বাইনারি’ বাস্তবকে পাল্টাতে চাইলে সমাজের সামনে অন্য ধরনের রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প পেশ করা জরুরি। অথচ বঙ্গীয় সিপিআইএমের চিন্তাভাবনা এখনও মান্ধাতা আমলের খোলস ছাড়েনি। এই অকূলপাথারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েও ওঁরা ‘সর্বক্ষণের কর্মী’ বাছাইয়ের শর্ত লাঘব করা যায় কি না সেই বিষয়ে ভাবিত! কাল বাদে পরশু অল্পক্ষণের কর্মী খুঁজে পাওয়াও যে কঠিন হতে পারে, এই বোধটুকুও দৃশ্যত দলনেতাদের নেই। এই সর্বজ্ঞ চিন্তাবীরদের কে বোঝাবে যে, ব্যর্থ গতানুগতিকতার অনুশীলন ছেড়ে যথার্থ এবং সর্বজনীন মানব উন্নয়নের দাবিতে সামাজিক আন্দোলনের পথই পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ্যা ও কদর্য রাজনীতির হাল ফেরাতে পারে। রাজ্যের বিরোধী পরিসরে তেমন সুচেতন রাজনীতির প্রয়োজন এবং সুযোগ দুই-ই বিপুল। সেখানেই বাম দলগুলির সামনে প্রকৃত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু জনসভার ভিড় মেপে তার হিসাব মিলবে না। মানবজমিন ডানকুনির ফুটবল মাঠ নয়, ব্রিগেডের ময়দানও নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

CPM Left

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।