E-Paper

সবার উপরে

বসন্ত চৌধুরীর মতো চেহারার আভিজাত্য বা জলদমন্দ্র স্বর তাঁর ছিল না, প্রেমের সংলাপ বলার সময় গলাটা নিচু তারে নামিয়ে নিতেন।

মহানায়ক।

মহানায়ক।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪২
Share
Save

কোনও কোনও মহলের বক্তব্য, বাঙালি এখন শুধুই রাজনীতিতাড়িত, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিল্প, বাণিজ্য সর্বত্র প্রথম ও দ্বিতীয় সারি থেকে বিতাড়িত, স্মৃতিকাতর পশ্চাৎপদ এক জনগোষ্ঠী মাত্র। বিনোদনী মানচিত্রেও তথৈবচ। বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর সকাতর অনুনয়েও ফল হয়নি, হিন্দি থেকে তামিল, তেলুগু, কন্নড় সকলেই জনপ্রিয়তায় তাকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও একটি বিষয়ে বাঙালি গর্ববোধ করতেই পারে। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে সে মৃত্যুকে পরাস্ত করে চলেছে। ২৪ জুলাই, উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন এলেই হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে। সেপ্টেম্বরে তাঁর জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিনটিকেই মনে রাখেন অধিকাংশ বাঙালি। মৃত্যুই আচম্বিতে টেনে দিয়েছিল দর্শককুলের সঙ্গে তাঁর ছেদ। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তিনি মহানায়ক, কৃত্রিম মেধার যুগেও তাঁর ছবির ক্লিপিং নিয়ে তৈরি হয় অতি উত্তম। তাঁর সমসাময়িক অন্য কারও এই রেকর্ড নেই। তামিল ছবিতে লাল স্যুট পরিহিত এমজিআর রাজনীতির কারণে স্মরণীয়, অন্ধ্রের নন্দমুড়ি তারক রামা রাও শুধু দেবমহিমান্বিত চরিত্রে, রাজ কপূর অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা-পরিচালনা সব মিলিয়েই অনন্য শো-ম্যান। কিন্তু তাঁদের কারও মৃত্যুদিনেই পত্রপত্রিকা, টিভি ও ব্লগ এত বিপুল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। উত্তরপ্রজন্ম কখনও মুগ্ধতার আবেশে সাদা-কালো ছবিকে রঙিন করে প্রযুক্তির ‘নয়া দৌড়’ প্রদর্শন করে। কিন্তু মৃত্যুর সাড়ে চার দশক পরেও পুরনো ক্লিপিং এবং অন্যের কণ্ঠে ভর করে পর্দা-উপস্থিতি থাকে না। এখানেই মৃত্যুর পরাজয়, বাঙালি সংস্কৃতির জয়। তাঁর জীবদ্দশাতেই তো বসন্ত বিলাপ ছবিতে চিন্ময় রায় প্রেমিকাকে বলেছিলেন, “শুধু একবার বলো, আমি উত্তমকুমার।” এখনও ছবির পর্দায় ব্যোমকেশ চরিত্রকে প্রেমাস্পদা বলেন উত্তমকুমারের মতো হতে। প্রেম এবং উত্তম কয়েক দশক ধরে বাঙালি জীবনে প্রায় সমার্থক, সে তাঁর বিপরীতে সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী বা মাধবী যে নায়িকাই থাকুন না কেন! পুরুষের এই ভুবনভোলানো হাসি বাঙালি আগে বা পরে কখনওই দর্শন করেনি।

অথচ, শারীরবৃত্তীয় নজরে দেখলে তাঁর ত্রুটিও ছিল। জিভেও ছিল জড়তা। বসন্ত চৌধুরীর মতো চেহারার আভিজাত্য বা জলদমন্দ্র স্বর তাঁর ছিল না, প্রেমের সংলাপ বলার সময় গলাটা নিচু তারে নামিয়ে নিতেন। সেখানেই প্রকাশ পেত স্বপ্নালু ঘনিষ্ঠতা। এই যে নিজের দুর্বলতা নিয়ে সচেতন, এবং বরাবর তাকে অতিক্রম করে যাওয়া, এই অভ্যাস বাঙালি চরিত্রে বিরল। শুধু একটি বছর ছবিতে সুপ্রিয়াকে বিরক্ত করা আর মৌচাক ছবিতে সাবিত্রীকে উত্ত্যক্ত করার হাসি এক নয়, দুটোই দাম্পত্যের গল্প হওয়া সত্ত্বেও! শুধু মুখের পেশির সঞ্চালন বা নির্দিষ্ট বাচনভঙ্গি নয়, প্রায় সারা শরীর দিয়ে চরিত্রে মিশে যেতেন তিনি। অমিতাভ বচ্চন তাঁর কেরিয়ারের শুরুতে আদালত ছবিতে পক্বকেশ বাবা ও কালো চুলের রাগী ছেলের দ্বৈত চরিত্রে ছিলেন। উত্তম কিন্তু শুরুর দিকেই খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ছবিতে বৃদ্ধ রাইচরণ! স্ত্রী এবং সন্ন্যাসী রাজা দু’টিই স্ত্রীর প্রতি অবহেলার জমিদার-কাহিনি। কিন্তু প্রথম ছবিতে লাম্পট্যের হাসি ও দ্বিতীয়টিতে অসহায়তার হাসি কতখানি আলাদা ও ব্যঞ্জনাময়, দর্শকমাত্রেই জানেন। শুধু ঠোঁট বা মুখ নয়, সারা শরীর দিয়ে হাসা যায় বলেই অমানুষ ছবির শেষ দৃশ্যে অনিল চট্টোপাধ্যায়কে বিদায় জানাতে গিয়ে হাসতে হাসতে উত্তম কাঁদেন। বিকেলে ভোরের ফুল ছবির শেষ দৃশ্যে ঠোঁটের কোণে প্রৌঢ়ত্বের বিষণ্ণমধুর হাসি, কিশোরী প্রেমিকাকে বলেন, “তুমি বড় হও, তার পর বুঝবে।” উত্তমকে শুধু মহানায়ক অভিধায় বন্দি রাখলে হবে না: ছাপোষা বাড়ির ছেলে, একের পর এক ফ্লপ ছবির নায়ক কী ভাবে মিথ হয়ে উঠলেন, তারও বিশ্লেষণ জরুরি। সেই জরুরি কাজ বরং এ বার শুরু হোক।

আসলে মিথ মানে শুধু অযোধ্যা বা বারাণসী নয়। বিখ্যাত ফরাসি চিহ্নতাত্ত্বিক লিখেছিলেন, অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর মুখ আসলে ‘আইডিয়া’ বা ধারণা, সব কিছুই ধারণ করতে পারে সে; আর অড্রে হেপবার্নের মুখ ‘ইভেন্ট’ বা ঘটনা। উত্তমকুমার একই সঙ্গে এই ধারণা ও ঘটনার মিশ্রণে তৈরি জটিল শরীরী অভিনয়-বিমূর্ততা। সেই বিমূর্ত হাসির পর্দা-স্মৃতিই হার মানায় শরীরী মৃত্যুকে। ভারতবর্ষ দূর অস্ত্, খ্যাতির তুঙ্গে থাকা মাইকেল জ্যাকসনের আচমকা মৃত্যুর ঘটনাতেও এমনটা ঘটেনি। প্রতি বছর ২৪ জুলাই দিনটি মনে করিয়ে দেয় বাঙালির নিজস্ব স্মৃতির আয়ুধে সাড়ে চার দশক আগের এক মৃত্যুজয়ের তাৎপর্য। বুঝিয়ে দেয় বাঙালি সংস্কৃতির বিশিষ্টতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Uttam Kumar Raj Kapoor

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।