E-Paper

উদ্যোগ কাহিনি

ব্যবসায়-উদ্যোগ বস্তুটি মননশীল কাজ নয়, ফলে তা বাঙালির কাজ নয়, এই হল যুক্তি। সদ্যসমাপ্ত ‘বিজ়নেস সামিট’ আর এক বার সেই কথাটি মনে করিয়ে দিল।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪৬
Share
Save

বাঙালির সঙ্গে ব্যবসায়-উদ্যোগের সম্পর্কটি কেমন, তা নিয়ে সম্ভবত চার পাশে বিশেষ মতানৈক্য নেই। সকলেই নিশ্চিত ও একমত যে, ও কাজটি বাঙালির দ্বারা হল না। অবশ্য বাঙালি নিজেই যখন এই কথা বলেন, আক্ষেপ-সুর নয়, বরং প্রত্যয়, আত্মাভিমান, শ্লাঘা ও উন্নাসিকতার সুরই ফুটে ওঠে তাঁদের উচ্চারণে। ব্যবসায়-উদ্যোগ বস্তুটি মননশীল কাজ নয়, ফলে তা বাঙালির কাজ নয়, এই হল যুক্তি। সদ্যসমাপ্ত ‘বিজ়নেস সামিট’ আর এক বার সেই কথাটি মনে করিয়ে দিল। উন্নয়নের সঙ্গে উদ্যোগের কী সম্পর্ক, সেই উদ্যোগ কম না বেশি, কম হলে কেন কম, ইত্যাদি বিশ্লেষণ পরের জন্য তোলা রেখেও একটি কথা স্মর্তব্য। বাঙালির ব্যবসায়-উদ্যোগের কোনও ইতিহাস নেই, সে কথা যেমন সত্য নয়— ইতিমধ্যে নানা গবেষণা ও লেখাপত্রে তা প্রতিষ্ঠিত— তেমনই এও সত্য যে কোনও এক অবিশ্লেষ্য কারণে বাঙালি সমাজের মূলস্রোতে সেই ইতিহাসকে যথাসাধ্য প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। ফলে বাঙালি উদ্যোগের ইতিহাসের রচয়িতাদের কাজ, এই শতাব্দী-অতিক্রমী পরিব্যাপ্ত নীরবতা, উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও উদাসীনতার মানচিত্রটিকেও ধরার চেষ্টা করা। এ এমন এক মানস-ইতিহাস, যা সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্ব স্তরে প্রভাব ফেলে গিয়েছে। শেষ অবধি তৈরি হয়েছে এক আত্মঘাতী হীনম্মন্যতা।

এই মানস-ইতিহাসের গোড়া খুঁজে যে কতটাই পিছনে চলে যাওয়া যায়! সংস্কৃত কলেজ থেকে যখন পদত্যাগ করেন বিদ্যাসাগর মশাই, তখন রসময় দত্ত প্রশ্ন তুলেছিলেন, কাজ তো ছাড়লেন, খাবেন কী। বেকার ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার সপাট জবাব ছিল, আলু-পটল বিক্রি করে, মুদির দোকান দিয়ে ‘খাবেন’ তিনি। রসময় দত্ত আর রা কাড়েননি, কিন্তু বিদ্যাসাগরই বা সে কথা কেন বলেছিলেন ভাবা জরুরি। বিদ্যায় ভূষিত মানুষের পক্ষে যে আলু-পটলের দোকান বা মুদির দোকান করা শোভা পায় না, সে ভাবনা তত দিনে বাঙালি পেশাদারি জীবনের গোড়ার কথা হয়ে গিয়েছে বলেই এমন উত্তরে রসময় দত্ত মশাইকে তিনি চুপ করিয়ে দিতে পেরেছিলেন। অবশ্যই শেষ অবধি বিদ্যাসাগর এ সব করেননি, তবে ব্যবসা একটি তৈরি করেছিলেন। প্রকাশনার ব্যবসা। বন্ধু ও সহকর্মী মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে সমান অংশীদারিতে বইয়ের ব্যবসায়ে মন দিয়েছিলেন, প্রেস ও টাইপ কিনে সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপোজ়িটরি নামে প্রকাশনা সংস্থা খুলেছিলেন। ভাবতে ইচ্ছা করে, আলু-পটল না হোক, বই ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে তাঁর ব্যবসায়িক আগ্রহ এতটা এগোতে পারত কি না। প্রশ্নটি তাঁর সাহস বিষয়ে সংশয় প্রকাশের চেষ্টা নয়, বরং বাঙালির মানসপ্রক্রিয়ার খোঁজখবর। সে দিনের বিদ্যাসাগরীয় উদ্যোগের চরিত্রই হয়তো বলে দেয়, কেন বই-মেলা আর বই-বাজারে বাঙালির উৎসাহময় চলাচল, কিন্তু শিল্পমেলা বা শিল্পবাজারে তার সিকিখানিকও নয়। আজ যাঁরা বিপুলাগ্রহে প্রকাশনা সংস্থা খুলে ফেলছেন, এবং প্রশ্নাতীত ভাবে ভাল কাজ করে প্রমাণ করছেন কতখানি তাঁদের উদ্যোগকুশলতা, তাঁরা কি অন্যান্য ব্যবসাক্ষেত্রের কথা ভাবতে পারতেন— কৌতূহল থেকেই যায়।

অবশ্যই, এই বৃহৎ মানস-সংস্কৃতির চালচিত্রটির প্রেক্ষিতে আলাদা উদ্ভাসে আলোকিত হয় বেশ কিছু নাম। তাঁদের এক জন উনিশ শতকের ব্রিটিশ-সমাকীর্ণ সমাজে বসে ভেবেছিলেন, দেশীয় ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি করতে হলে বিদেশিদের ব্যাঙ্কে চলবে না, আলাদা ব্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে। ১৮২৮ সালে তৈরি হয়েছিল ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। এও ভেবেছিলেন, ইউরোপীয় ব্যবসাদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোম্পানি তৈরি করা যেতে পারে। ১৮৩৪ সালে তৈরি হয় কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের এই প্রণোদনার কিছু কি পাননি তাঁর খ্যাতিমান পৌত্রটিও? বড় শিল্পোদ্যোগ পেরে উঠবেন না ভেবে পল্লিসমাজের গ্রামীণ লোকায়ত শিল্পকে কেন্দ্র করে রবি ঠাকুর যে কর্মকাণ্ড তৈরি করলেন, তার এক-শতাংশ উদ্যোগও কি নিতে পেরেছেন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা? চামড়া, বাঁশ, কাঠ, বেত দিয়ে হস্তচালিত শিল্পের বিপণনের জন্য যে কেন্দ্র খোলা হল, ১৯৩৮ সালে তার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তবে কিনা, ব্যবসায়ের সঙ্গে ওতপ্রোত যে বেচাকেনা, তার হীনতাবোধ কি ছিল না রবীন্দ্রমানসেও? নতুবা শ্যামার বজ্রসেন কেনই বা বলবেন, “না না বন্ধু, আমি অনেক করেছি বেচাকেনা, অনেক হয়েছে লেনাদেনা।” বাঙালি যুগপুরুষদের মন ও মনন সন্ধান থেকেই শুরু হতে পারে বাঙালি উদ্যোগবিমুখতার কাহিনি, যার মধ্যে বাঙালির আত্মবিকাশ ও তার সীমা-পরিসীমার ধরনটি উন্মোচিত হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BGBS 2025 Bengalis Entrepreneurs

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।