—প্রতীকী ছবি।
একটাই পৃথিবী— এই বার্তা নিয়ে ১৯৭৩ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল ৫ জুন তারিখটি। গত সোমবার তার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। এই পঞ্চাশ বছরে পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের জৌলুস বিস্তর বেড়েছে। দুনিয়া জুড়ে সভা, সমাবেশ, বক্তৃতা, প্রদর্শনী, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার ইত্যাদি আচারের কোনও অভাব এই বছরেও ঘটেনি। কিন্তু গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিচারে অন্য এমন নানা ‘দিবস’-এর সঙ্গে এই দিনটির একটি মৌলিক পার্থক্য আছে, যার মূলে কাজ করছে, আক্ষরিক অর্থেই, অস্তিত্বের প্রশ্ন। গত তিন দশকে বিশ্ব পরিবেশের সঙ্কট সম্পর্কে দুনিয়ার মানুষ উত্তরোত্তর ওয়াকিবহাল হয়েছেন। গত এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে সেই সঙ্কটের ধারণা দ্রুতগতিতে জোরদার হয়েছে, ২০১৫ সালের শেষে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে যে প্রক্রিয়া একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়— পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড়পড়তা তাপমাত্রাকে শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উপরে বেঁধে ফেলার অঙ্গীকার করেন বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা।
কিন্তু প্রতিশ্রুতির তুলনায় কাজের কাজ বিস্তর পিছিয়ে। উত্তর মেরু-সহ গ্রহব্যাপী হিমবাহের ক্ষয় চলছে অবিরাম গতিতে, ‘চরম আবহাওয়া’র প্রকোপ বেড়ে চলেছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে আর চার বছরের মধ্যেই ১.৫ ডিগ্রির বিপদসীমা লঙ্ঘিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু শুধু তাপমাত্রা নয়, অরণ্য-সংহার এবং জীববৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি থেকে শুরু করে প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্য সমস্ত ধরনের বিপদও অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে চলেছে। এই গ্রহের ইতিহাসে ষষ্ঠ ‘এক্সটিংশন’ বা মহাপ্রলয়ের সম্ভাবনা উত্তরোত্তর জোরদার হয়ে উঠছে। এর আগের পাঁচটি প্রলয়ে গ্রহবাসী প্রাণীদের কোনও দায় ছিল না, কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী দুই বা আড়াই শতাব্দীর মধ্যে মানুষ নামক প্রজাতি প্রকৃতি-পরিবেশের উপর যে অকল্পনীয় অত্যাচার চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে, পরবর্তী প্রলয় হবে তারই পরিণাম। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অর্ধশতক পার হল বটে, শতবার্ষিকী উদ্যাপনের সুযোগ মানুষ পাবে তো?
প্রশ্নটা সারা বিশ্বের পক্ষে সত্য, তবে সমস্ত দেশের বা অঞ্চলের পক্ষে সমান সত্য নয়, একই অঞ্চলের সব মানুষের পক্ষেও সমান প্রাসঙ্গিক নয়। মহাপ্রলয়ের ধারণাটি যত চিত্তাকর্ষক, ততটা বাস্তবসম্মত না-ও হতে পারে। গোটা পৃথিবী একই সঙ্গে একই ভাবে বিপর্যস্ত হবে, এমনটা আদৌ অবধারিত নয়। ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, সমুদ্রের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলির বিপদ সর্বাধিক, এমনকি তাদের বিরাট অংশের অস্তিত্বই বিপন্ন— বহু এলাকা ইতিমধ্যেই সমুদ্রের গ্রাসে চলে গিয়েছে। আবার, অনেক এলাকায় সুতীব্র অনাবৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে পারে। এবং এই সমস্ত ক্ষেত্রেই সর্বাধিক আক্রান্ত হচ্ছে ও হবে দরিদ্র অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা। ‘একটাই পৃথিবী’ নামক প্রচারের আড়ালে আছে চিরাচরিত অসাম্যের বাস্তব— পিলসুজের উপরে প্রদীপের আলো আর নীচে অন্য ইতিহাস। ভারতের মতো দেশে সমস্যার মাত্রা আরও বেশি। এক দিকে বিপুল অনগ্রসরতা, অন্য দিকে বিরাট ও ক্রমবর্ধমান অসাম্য, দুইয়ের যৌথ প্রকোপে পরিবেশের সঙ্কট এক বিভীষিকায় পরিণত হচ্ছে। অথচ এই বিভীষিকার মাত্রা সম্পর্কে সমাজ এবং রাষ্ট্র, কেউই যথেষ্ট সচেতন নয়। প্লাস্টিক নামক দানবটিকে নিয়ন্ত্রণের উপরে এ বছর পরিবেশ দিবসে সরকারি ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই— পশ্চিমবঙ্গ তথা তার রাজধানী শহরেও— প্লাস্টিকের সাম্রাজ্য অপ্রতিহত। অন্য দিকে, উন্নয়নের গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে পরিবেশকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা এখনও অতিমাত্রায় দুর্বল। ৫ জুন ক্যালেন্ডারের নিয়মেই আসবে এবং— অন্তত আরও কিছু কাল— যাবে। কিন্তু বাকি দিনগুলি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy