তাপস সিংহের ‘নীরব দর্শক ছিলেন না তিনি’ (৬-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করে স্বাধীন ভারতের এক জন নাগরিক হিসেবে আবার আত্মধিক্কার অনুভব করলাম। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এ কোন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ সাধারণ নাগরিক? ১৯৪৭-এ নবীন স্বাধীন ভারতের শাসনযন্ত্র তখন কংগ্রেসের হাতে। সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের রহস্য তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র কিছুতেই উন্মোচিত হতে দেয়নি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে তাঁকে প্রায় ছেঁটে দেওয়া হল। বন্দিদশায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রহস্যময় মৃত্যুরও এখনও অবধি কিনারা হয়নি। এই ধারাতেই এ বার জেশুইট ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর মৃত্যু দেখল দেশবাসী। কোন অপরাধ করেছিলেন এই অশীতিপর সমাজসেবী? জনজাতিদের জন্মগত অধিকার সম্বন্ধে তাঁদের সচেতন করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পূজারি, ভারতে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করছিলেন, তাঁদের নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর আপসহীন প্রতিবাদ। অপরাধী চিহ্নিতকরণে অভিনব শব্দবন্ধ এল শাসকের মস্তিষ্কে, ‘আরবান নকশাল’। যাঁরা নামকরণটি করেছেন, তাঁরা কোন বিচারে এমন একটি নামকরণ করলেন, বোঝা গেল না। একটি মতবাদ বা একটি আন্দোলনের গ্রাম-শহর ভাগাভাগি হয় নাকি?
দলীয় রাজনীতিপুষ্ট শাসকশক্তির রাষ্ট্রনৈতিক সন্ত্রাস, অমানবিক নির্মমতা, পরাধীন ভারতে যেমন ছিল, স্বাধীন ভারতেও তার চরিত্র কিছুমাত্র বদলায়নি। ফাদার স্ট্যানের মতো এক জন অতি অসুস্থ, বরিষ্ঠ নাগরিকের উপর যে উৎপীড়ন চালানো হয়েছে, তার যথেষ্ট কারণ এই শাসনযন্ত্র দিতে পারবে কি?
সত্যব্রত দত্ত, কলকাতা-৮৪
অবিচল সংগ্রামী
‘নীরব দর্শক ছিলেন না তিনি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তাপস সিংহ ফাদার স্ট্যান স্বামী সম্পর্কে যথার্থই লিখেছেন, “নিজের কর্মজীবনের প্রায় গোটা পর্ব জুড়ে জনজাতিদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এই পাদরি।” ভারত সরকার-প্রণীত বহু দমনপীড়ন মূলক আইনের সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি বার বার প্রশ্ন তুলেছেন। শাসকের বহু সিদ্ধান্তকে দাঁড় করিয়েছেন আইনি কাঠগড়ায়। যেমন, তিনি দীর্ঘ দিন দাবি জানিয়ে এসেছেন সংবিধানের পঞ্চম তফসিলকে কার্যকর করার। এর অন্তর্গত সংবিধানের ২৪৪(১) ধারায় প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যে একটি করে ‘আদিবাসী উপদেষ্টা কাউন্সিল’ গঠনের বিধান আছে, যা গঠিত হবে আদিবাসী ও মূলনিবাসী জনজাতির সদস্যদের দ্বারা, এবং সেই কাউন্সিল রাজ্যপালকে আদিবাসী ও মূলনিবাসী জনজাতির সুরক্ষা ও উন্নয়নের বিষয়ে পদক্ষেপ করতে সুপারিশ করবে। আদিবাসী ও মূলনিবাসী জনজাতির এই সাংবিধানিক অধিকারকে সরকার খর্ব করে আসছে।
কেন সরকার ‘পঞ্চায়েত (বর্ধিত তফসিল অঞ্চল) আইন’ অমান্য করছে, এই প্রশ্ন বার বার তুলেছেন ফাদার স্ট্যান স্বামী? ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে বলা হয়, আদিবাসী জনজাতির বাসভূমি যে সমস্ত জমি বা জঙ্গলে আছে, সেখানে খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলে খনিজ নিষ্কাশনের সময় তাঁদের জীবন, জীবিকা ও বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, এবং নিষ্কাশিত খনিজ সম্পদের উপর তাঁদেরও অধিকার থাকবে। কিন্তু এই রায় মানা হয়নি, এই বিষয়েও সরব হয়েছেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনের অসম্পূর্ণ প্রয়োগের বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। এই আইনের লক্ষ্য ছিল যে, আদিবাসী ও অরণ্যবাসী মানুষের উপর যে ঐতিহাসিক অবিচার হয়েছে, তার নিরসন করা। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে, যিনি জমির মালিক তিনিই জমির নীচে রক্ষিত সমস্ত সম্পদের মালিক। কিন্তু বিভিন্ন সরকার বার বার কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ নিলাম করে বহুজাতিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। ঝাড়খণ্ড সরকার জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ সংশোধনের মাধ্যমে বহুফসলি কৃষিজমিও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করেছে। এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছিলেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। সরকারের ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ নীতির স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
ফাদার স্ট্যান স্বামী ‘নকশাল’ সন্দেহে আদিবাসী মানুষদের নির্বিচারে গ্রেফতার ও বিনা-বিচারে বন্দি করে রাখার বিরোধিতা করেন। তিনি ঝাড়খণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে করা একটি জনস্বার্থ মামলায় আবেদন করেন, ১) সমস্ত বিচারাধীন বন্দিকে ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দিতে হবে, ২) সমস্ত বন্দির বিচার করে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে, ৩) মামলাগুলিকে দীর্ঘ দিন ফেলে রাখার কারণ তদন্ত করতে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে, ৪) পুলিশ সমস্ত বিচারাধীন বন্দির ব্যাপারে সমস্ত তথ্য আদালতে ও অভিযুক্তের আইনজীবীকে জানাবে।
এই মামলার দু’বছর পরেও পুলিশ বিচারাধীন আদিবাসী বন্দিদের ব্যাপারে কোনও তথ্য দেয়নি। ভারতের বিভিন্ন জেলে আটক রাজবন্দিদের জন্য গঠিত ‘পারসিকিউটেড প্রিজ়নারস সলিডারিটি কমিটি’-র জন্য অর্থ সংগ্রহ, এবং আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদবিরোধী সংগঠন ‘বিস্থাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন’-এ কাজ করার জন্য ফাদারকে ‘মাওবাদী কর্মী’ আখ্যা দেওয়া হয়। এনআইএ-র মতে, দু’টি সংগঠনই মাওবাদীদের প্রকাশ্য মঞ্চ।
২০২১ সালের মে মাসে ফাদার মুম্বই হাই কোর্টে বলেছিলেন, “আমি যখন তালোজা জেলে এসেছিলাম তখন আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ ভাল ছিল। গত আট মাসে আমার সমস্ত শরীর দ্রুত ক্ষয় হয়েছে। আট মাস আগে আমি নিজের হাতে খেতে, লেখালিখি করতে ও হাঁটতে পারতাম, এখন আর পারি না।” আট মাসের কারাগার জীবন তাঁর জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছিল। তিনি বার বার দেশের বিচারব্যবস্থার কাছে অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্তি চাইছিলেন। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র পুলিশ সুপার বিক্রম খালাটে তাঁর মেডিক্যাল জামিন বাতিল করে, তাঁর অসুস্থতার আরও ‘কড়া প্রমাণ’ দাবি করেছিলেন।
১৯৭৮ সালে প্রণীত সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনী আইনে বলা হয়, জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রপতি বিশেষ ঘোষণা বলে অন্য মৌলিক অধিকারগুলি সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখতে পারলেও, ২১ ধারায় বর্ণিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে কখনওই স্থগিত রাখা যাবে না। অথচ, খালাটে বলেছিলেন, ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতো অপরাধীর ক্ষেত্রে নাকি ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা কোনও ভাবেই প্রযুক্ত হবে না। এ যেন জরুরি অবস্থার চেয়েও কঠোর কোনও ব্যবস্থা। ফাদার স্ট্যান স্বামীর সংগ্রাম এ দেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে।
অজেয় পাঠক, ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ক্ষুধার রাজ্যে
‘সুষম আহারে বঞ্চিত ৯৭ কোটি ভারতীয়: রাষ্ট্রপুঞ্জ’ (৯-৭) খবরটি আশঙ্কার। কমপক্ষে ৭১% ভারতবাসীর নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে পুষ্টিকর খাবার, স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে এ কি এক অভিশাপ নয়? মহিলা ও শিশু উন্নয়ন খাতে কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় ক্রমশ কমছে। নীতি ও উন্নয়ন উপদেষ্টা সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, শিশু অপুষ্টির কারণে ভারত তার জিডিপির ৪ শতাংশ এবং উৎপাদনশীলতার ৮ শতাংশ হারায়। আসলে মানবসম্পদ রক্ষার স্বার্থে অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণের কাজ যদি না হয়, উৎপাদনশীলতা ও আর্থিক বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে পড়ে। তথ্য বলছে, ভারতের রোগ-ব্যাধির ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী শিশু ও মায়ের অপুষ্টি। অথচ, একশো দিনের কাজ, আইসিডিএস, অঙ্গনওয়াড়ি ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প খাতে বরাদ্দ কমছে। ও দিকে কর্মহীনতা বাড়ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১ অনুযায়ী, ভারত ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম অবস্থানে নেমে এসেছে। ক্ষুধা ও অপুষ্টির মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও দায়িত্বশীল?
পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy