একসঙ্গে: নন্দকুমারের খঞ্চিতে মেয়ের সঙ্গে মায়েরাও ক্যারাটে শিখছেন। নিজস্ব চিত্র
জেলায় মেয়েদের মার্শাল আর্টের এখন দু’টি ধারা। ক্যারাটে ভালবেসে শিখতে আসা। তার পর একাগ্র অনুশীলনে সাফল্য পাওয়া। এটা হল প্রথম ধারা। দ্বিতীয় ধারা হল আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে শেখা। শিখতে শিখতে প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া। তার পর সাফল্য পাওয়া। দ্বিতীয় ধারার আরেকটি উপধারা আছে। আত্মরক্ষায় ক্যারাটে শেখা বজায় রাখা। প্রথম ধারায় বেশির ভাগই স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। দ্বিতীয় ভাগে চাকরিরতা, বধূ এবং স্কুল পড়ুয়া, সব ক্ষেত্রের মেয়েরাই রয়েছেন।
হাতেনাতে সফলদের হাজির করা যাক। ঝাড়গ্রামের মৌমিতা চক্রবর্তী বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। আত্মরক্ষায় স্বনির্ভর হতে তাঁকে ক্যারাটে শিখতে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছেন। কলেজ ছাত্রী মৌমিতা এখন ঝাড়গ্রামে শিশুদের শেখান। ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় একটি কোচিং সেন্টার করার কথা ভাবছেন। তমলুকের সোহিনী মাইতি ও শ্রেয়সী দত্ত আত্মরক্ষায় ক্যারাটে শিখতে শুরু করেছিল। এখন ক্যারাটের প্রশিক্ষক হতে চাইছে।
মেদিনীপুরের প্রিয়ঙ্কা বিশাইয়ের কাহিনি একটু অন্য। তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন। তার জবাব দিতেই ক্যারাটে শেখা শুরু। এখন তিনি ব্ল্যাক বেল্ট। ক্যারাটে শেখাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মতো কেউ যাতে আর এরকম ঘটনার শিকার না হয় তাই মেয়েদের ক্যারাটে শেখাই।’’
মেয়েদের ক্যারাটে শেখার প্রবণতা বাড়ছে। বহুদিন থেকেই। সমাজ, পরিস্থিতিগত কারণে ক্যারাটে শিখতে আসেন বহুজন। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে স্কুলগুলোতেও আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৩-১৪ সালে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযানের তরফে স্কুলের মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়া শুরু হয়। প্রথম বছর মাত্র ১৪টি বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছিল। এর জন্য এক একটি বিদ্যালয় ন’হাজার টাকা পায়। এর পর বহু স্কুলেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০১৮ সাল থেকে এই খাতে টাকা না আসায় বিদ্যালয়ে আর প্রশিক্ষণ হচ্ছে না।
তবে জেলার বিভিন্ন ক্যারাটে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মেয়েরা। দেখা যাচ্ছে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মেদিনীপুর শহরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক রাসবিহারী পাল জানান, ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ ছেলে ও ৪০ শতাংশ মেয়ে ছিল। এখন তাঁর ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৭০০ জন। তাঁদের মধ্যে ৪০০ জন মেয়ে। সুচরিতা সিংহ, সঙ্ঘমিত্রা সিংহ, অঞ্জনা সিংহ স্কুলের হয়ে রাজ্য স্তরে সাফল্য পেয়েছে। প্রথম দু’জন ফেডারেশন কাপে সফল হয়েছে। বৃষ্টি খাতুন ডিএভি স্কুলের জাতীয় স্তরে সফল। কলেজে পড়া শেষ করে চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন অনন্যা জানা। তিনিও ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছেন। রাসবিহারী বলেন, ‘‘এখন সামাজিক অবস্থার সঙ্গে লড়াই করার জন্য মেয়েরা তৈরি হচ্ছে।’’
মেদিনীপুর শহরের আরেক ক্যারাটে প্রশিক্ষক সোমনাথ দে জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালে তাঁর কাছে ১৩০ জন প্রশিক্ষণ নিতেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৩০ শতাংশ মেয়ে ছিল। এখন তাঁর কাছে যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন তাঁদের প্রায় ৬০ শতাংশই মেয়ে। ২১০ জন প্রশিক্ষণ নেন তাঁর কাছে। তাঁদের মধ্যে ৯৫-১০০ জন মেয়ে। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা ঘোষ ওপেন ন্যাশনালে সফল হয়েছে। আনিশা সাউ স্কুলের রাজ্য স্তরে সফল। সোমনাথবাবু বলেন, ‘‘আমাদের এখানে সপ্তাহে একদিন লড়াইয়ের ক্লাস থাকে। সেখানে সরাসরি লড়াই করতে হয়। অনেক সময় একজন আরেক জনের কাছে আঘাত খেয়ে ভয় পেয়ে যায়। তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে প্রত্যাঘাত করে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। হাতেনাতে এই শিক্ষা নেওয়া থাকলে বাস্তবে মেয়েরা কারও থেকে আঘাত পেলে প্রত্যাঘাত দিতে পারবে।’’
ঝাড়গ্রাম জেলায় এক প্রশিক্ষক গৌরাঙ্গ পাল জানান, ২০১৫ সালে এখানে ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৩০ শতাংশ মেয়ে ক্যারাটে প্রশিক্ষণ নিত। এখন অঙ্কটা উল্টে গিয়েছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ৭০ শতাংশ মেয়ে। গৌরাঙ্গবাবু জানান, বেশির ভাগ মেয়ে ছোট থেকে শেখে। অনেক মেয়ে কলেজে পড়ার সময় বা চাকরি করার সময় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। গৌরাঙ্গবাবু বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রামে আমার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছ’জন মেয়ে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বাছুরডোবার শিখা চট্টোপাধ্যায়। রঘুনাথপুরের মৌমিতা চক্রবর্তী কলেজ পড়ুয়া।’’ গৌরাঙ্গের কথায়, ‘‘আগে বড় মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিতে আসতেন না। সামাজিক পরিস্থিতির কথা ভেবে এখন কয়েক বছর হল তাঁরাও প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন।’’ গৌরাঙ্গের কাছে প্রশিক্ষণ নেন প্রায় ২৫০ জন। তাঁদের ১৭০ জন মেয়ে। সঞ্জনা বেরা ও সায়নী পাত্র স্কুলের রাজ্য স্তরে ভাল ফল করেছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের এক প্রশিক্ষক সুদীপ্ত দাস জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে তাঁর কাছে ১০৬ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০-২২ জন মেয়ে ছিল। ২০২০ সালে ৪২২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০৪ জন মহিলা। এঁদের মধ্যে ১০-১৮ বছরের মেয়ে প্রায় ২০০ জন। কলেজ পড়ুয়া প্রায় ৭০-৮০ জন। ১৫-২০ জন বধূ ও চাকরিরতা। সোহিনী মাইতি, শ্রেয়সী দত্ত স্কুল স্তরের রাজ্য প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের এক প্রশিক্ষক পবিত্র গোস্বামী ২০১৫ সালে খঞ্চিতে মাত্র পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির শুরু করেছিলেন। ২০২০ সালে ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১৫০ জন মেয়ে। এঁদের মধ্যে কয়েকজন চাকরিজীবীও রয়েছেন। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেয়ের সঙ্গে মায়েরাও প্রশিক্ষণ নেন। খঞ্চির কণিকা সামন্ত ও তাঁর মেয়ে অঞ্জনা একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কনিকাদেবী বলেন, ‘‘এখন সমাজের নানা ক্ষেত্রে মেয়েদের উপর শারীরিকভাবে নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। তাই ৪০ বছর বয়সে মেয়ের সঙ্গে ক্যারাটে শিখছি।’’ পবিত্রের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাউরের বধূ শর্মিষ্ঠা কর নিজে একটি প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছেন। সেখানে মাঝেমধ্যে পবিত্র প্রশিক্ষণ দেন। শর্মিষ্ঠাদেবী বলেন, ‘‘আমার বয়স এখন ৪২। ৩৬ বছর বয়স থেকে আমি ক্যারাটে শিখছি। এখন আমি অন্যদের প্রশিক্ষণ দিই। আমার মেয়েকেও আমি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’’ পবিত্র বলেন, ‘‘আমি মেয়েদের সুরক্ষার কথা ভেবেই পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির শুরু করেছিলাম। এখন মেয়েদের সঙ্গে মায়েরাও প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন।’’
২০২০ সাল থেকে রাজ্য সরকারের ‘সুকন্যা’ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার পুলিশের তরফে স্কুলের মেয়েদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে পুলিশের তরফে সব বিদ্যালয়েই মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানার আয়োজনে শহরের বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার বলেন, ‘‘জেলার সমস্ত বিদ্যালয়ের মেয়েদের সেলফ ডিফেন্সের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা যদি প্রশিক্ষণ নিতে চায় সেক্ষেত্রে আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব।’’
আত্মরক্ষায় স্বনির্ভর হলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আত্মবিশ্বাস থেকে সাফল্য আসে। প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মৌমিতা, প্রিয়ঙ্কা, সোহিনী, শ্রেয়সীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy