Advertisement
E-Paper

দেহের সীমানা ঠিক করবে কে

বিশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে, এবং তার অব্যবহিত পরে মোহনদাস গান্ধীর রাজনৈতিক বয়ানে পোশাক হয়ে উঠল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম ক্ষেত্র।

মল্লারিকা সিংহ রায়

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪০
Share
Save

নারীদেহকে প্রকাশ্যে আনতে গেলে কী ধরনের বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়তে হয়, সাম্প্রতিক হিজাব-বিতর্ক তারই একটি নিদারুণ উদাহরণ। ধর্ম, বর্ণ এবং শিষ্টাচার বিধান দিয়ে থাকে, কোন পোশাকে একটি নারী সমাজের লোকচক্ষুর সামনে এসে দাঁড়ালে তা হবে শোভন। এটি পোশাকের বাহুল্য, দৈর্ঘ্য বা স্বল্পতার প্রশ্ন নয়, যদিও দৈনন্দিন তর্কাতর্কি বিষয়টিকে ক্রমাগত সেই দিকেই ঠেলতে থাকে। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে স্থান এবং কাল বিশেষে সামাজিক নিয়মাবলি শালীনতার সীমানা বার বার নির্ধারণ করে দেয়, এবং মেয়েদের সেই নিয়ম মেনে নিয়ে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হয়।

একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক। পোশাকের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন যে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কোম্পানির সাহেব কর্মচারীরা ‘শাড়ি’ নামের পোশাকটি ভারতীয় নারীদের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে নির্বিচারে ব্যবহার করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতক থেকে। কোম্পানি আমলের ছবিতেও ক্রমশ সাধারণ পরিধেয় আর বিশেষ উপলক্ষের পোশাকের ব্যবধান ঘুচে যেতে থাকে। অনেক সময়ে জাতি, শ্রেণি, ধর্ম ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে পুরুষ-নারীর জুটির ছবি আঁকা হত নৃতাত্ত্বিক নমুনা হিসেবে। এই ছবিগুলি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ভারতীয়দের পোশাক দিয়ে কেমন করে চিনে নিতে হবে, তার নথি তৈরি করা শুরু হল। ভারতের মানুষ যেন একটিমাত্র কালখণ্ডের মধ্যে তার পোশাকের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে গেল, যার আর লয়-ক্ষয় নেই। এরই মধ্যে নারীদেহের আব্রু রক্ষার ব্যাপারে খ্রিস্টান পাদরিরাও নিজেদের প্রভাব খাটাতে শুরু করলেন। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভিক্টোরীয় মানসিকতার প্রবেশ শুরু হল।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে, ত্রিবাঙ্কুরে ১৮১২-১৩ সালে দলিত নারীদের বক্ষ-আবরণী ব্যবহার করার আইনি অনুমতি নিয়ে বিতর্ক, যা দাঙ্গা পর্যন্ত ঘটিয়ে দিয়েছিল। নিচু জাতের নারীদের সেই আবরণী ব্যবহার করার নিয়ম ছিল না। উচ্চ এবং মধ্যম জাতির নারীদের প্রকাশ্যে বেরোনোর জন্য দেহ আবৃত করার যে অধিকার ছিল, তা অর্জন করতে দলিত জাতির মেয়েদের বহু লাঞ্ছনা পেতে হয়েছিল। রবার্ট হার্ডগ্রেভ এই ‘ব্রেস্ট ক্লথ’ বিতর্ক, তার আইনি এবং সামাজিক ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। ত্রিবাঙ্কুরের রাজশক্তি, সেখানকার ব্রিটিশ রেসিডেন্ট, ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্তম্ভস্বরূপ নেতৃবৃন্দ এবং খ্রিস্টান পাদরিরা এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যেও মতবিরোধ কম হয়নি। বোঝা যায়, নারীপোশাকের ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়মাবলিতে জাতি, বর্ণ এবং ধর্ম কত ভাবে নির্ধারকের ভূমিকা নিয়েছে। নারীরা দেহের কোন অংশ আবৃত করে প্রকাশ্যে বেরোবেন, কী ভাবেই বা শালীনতা এবং জাতিভেদের সীমানা নির্ধারিত হবে, তা নিয়ে পিতৃতন্ত্রের নানা শাখার মধ্যে মতভেদ ঘটেছে।

বিশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে, এবং তার অব্যবহিত পরে মোহনদাস গান্ধীর রাজনৈতিক বয়ানে পোশাক হয়ে উঠল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম ক্ষেত্র। যে নারীরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে পথে বেরিয়ে এলেন, তাঁরাও ক্রমেই এক বিশেষ ভঙ্গিতে কাঁধে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরে তাকে করে তুললেন জাতীয়তাবাদীর পোশাক। এই ভাবে শাড়ি পরা প্রথম শুরু করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ১৮৭০-এর দশকে, পার্সি ধরনে শাড়ি পরায় সামান্য কিছু অদল-বদল করে।

স্বাধীনতা-উত্তর কালের সমাজে শাড়ি পরার রীতিতে বৈচিত্র, বা নারীর অন্যান্য পোশাক স্থান পেয়ে গেল ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর ধারণায়। শিশুপাঠ্য বইয়ে দেখা যেত ভারতে নানা রাজ্যের নরনারীর ছবি, যেখানে মেয়েরা পরেছে কোথাও সালোয়ার কামিজ়, কোথাও ঘাগরা-ওড়না, কাছা-দেওয়া অথবা কুঁচি-দেওয়া শাড়ি, অথবা কোনও জনজাতির নিজস্ব পরিধান। স্থানিক পরিচয়, বর্ণ, জাতিরও পরিচায়ক হচ্ছে পোশাক। ভারতের কয়েক কোটি মুসলমান মহিলাকে যে সামাজিক অনুশাসন মেনে হিজাব অথবা বোরখা পরতে দেখা যায়, তার স্থান নেই এ সব ছবিতে। আমরা যেন ভুলেই গিয়েছি যে, বেগম রোকেয়ার মতো মানুষ বিদ্রুপের কশাঘাতে বার বার মুসলমান নারীর ‘অবরোধবাসিনী’ হয়ে থাকার অপমানকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে। এও মনে রাখিনি যে, এই বেগম রোকেয়াকেই কিন্তু পর্দা মানতে হত, যাতে তাঁর ইস্কুলে ছোট ছোট মুসলমান মেয়েরা পড়তে আসতে পারে। কারণ, তিনি পর্দা না মানলে গোঁড়া অভিভাবকরা মেয়েদের ইস্কুলে পড়ার পাটই তুলে দেবেন।

সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হলে কোন পোশাকে তা করা যেতে পারে, বা কোন বিদ্রোহ কখন করা জরুরি, প্রশ্নগুলি গুরুতর। পোশাকের রাজনীতির ইতিহাস অন্তত আমাদের এইটুকু শেখাতে পারে যে, নিজের দেহকে কোন পোশাকে সাজিয়ে এক জন নারী প্রকাশ্যে আসবে সেটা তার উপরে ছেড়ে দেওয়াই গণতান্ত্রিক নীতি।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

Women clothes hijab

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।