Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Folk Songs

কোন সুদূর হতে মুক্তির সুর

মধ্যযুগের চন্দ্রাবতী নারীশক্তির গল্প জানতেন না। তিনি ভারতচন্দ্রও পড়েননি। অথচ নারীর প্রেমের স্বাধীনতা তিনি বুঝিয়েছেন অনায়াসে।

A Photograph representing Function

১৯২৩ সালে প্রকাশিত মৈমনসিংহ গীতিকা’র গানগুলি তার বেশ কিছু বছর আগে সংগৃহীত। ফাইল ছবি।

ঈশা দেব পাল
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৩ ০৪:২৪
Share: Save:

মেয়েটি কলসিতে জল ভরে এই বলে, “শুনরে পিতলের কলসী কইয়া বুঝাই তরে।/ ডাক দিয়া জাগাও তুমি ভিনপুরুষেরে।” তার সঙ্গে সে দিন এমন সঙ্গী কেউ ছিল না যার সাহায্যে সে হঠাৎ ভাল লেগে যাওয়া এক বিদেশি পুরুষের ঘুম ভাঙাবে, তাকে ডেকে পরোক্ষে নিমন্ত্রণ করবে বাড়িতে। মলুয়া নামের মেয়েটি উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগায়, অবলম্বন করে পিতলের কলসি, নদীর জল আর পোষা ‘কুড়া’কে। ভিনদেশির ঘুম ভাঙে, সে মুগ্ধ হয়ে দেখে: “এইত কেশ না কন্যার লাখ টাকার মূল।/ শুকনা কাননে যেন মহুয়ার ফুল।।/ ডাগল দীঘল আখি যার পানে চায়।/ একবার দেখলে তারে পাগল হইয়া যায়।।”

১৯২৩। একশো বছর আগে চন্দ্রকুমার দে-র সংগৃহীত পালাগুলি সম্পাদনা করে দীনেশচন্দ্র সেন প্রকাশ করেছিলেন মৈমনসিংহ গীতিকা, তারই অন্তর্গত ‘মলুয়া’ নামের এই পালাটি সম্ভবত রচনা করেছিলেন চন্দ্রাবতী, যিনি রামায়ণ রচয়িতা হিসেবেও খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, মৈমনসিংহ গীতিকা’র “কালনির্ণয় চলেনা, জাত নির্ণয় চলে, ওটা আবহমান কালের, কেবল ওটা কলেজিকালের বাইরে।”

মধ্যযুগের চন্দ্রাবতী নারীশক্তির গল্প জানতেন না। তিনি ভারতচন্দ্রও পড়েননি। অথচ নারীর প্রেমের স্বাধীনতা তিনি বুঝিয়েছেন অনায়াসে, দেখিয়েছেন মলুয়ার প্রেমের স্বাধীন সত্তা, আবার কাজি বা দেওয়ানের মতো রাষ্ট্রশক্তি এবং পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতাও। যদিও এ সব কাহিনির প্রেক্ষাপট মধ্যযুগীয়, কিন্তু এর উদ্ধার যে সময়ে, তখনকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা মনে রাখলে মলুয়া চরিত্রটিকে তত আকস্মিক মনে হয় না, বরং বিশেষ সেই সময়ে মলুয়ার মৌখিক নির্মাণে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, রমাবাই, বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী বা সরলা দেবী চৌধুরাণীদের লড়াই। ‘জাতীয় সংগ্রাম ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্ন’ প্রবন্ধে অনুরাধা রায় লিখেছেন, “বিশ দশকের গোড়ায় বঙ্গভঙ্গ তথা স্বদেশি আন্দোলন। এই প্রথম জাতীয় আন্দোলন স্পষ্ট ব্রিটিশ বিরোধী চেহারা নিল। অরন্ধন, বয়কট, দেশীয় দ্রব্যের ব্যবহার ছিল তার প্রধান হাতিয়ার। আর এ সবের জন্য মেয়েদের সহযোগিতা দরকার ছিল। ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ শুনিয়ে এবং আরো নানাভাবে মেয়েদের কাছে সহযোগিতার জন্য আবেদন রাখা হয়েছিল। ঘরের মধ্যে থেকে নারীভূমিকাতেই তাদের অংশ নিতে বলা হয়েছিল।” ঐতিহ্যের কাহিনিতে নারীর নবনির্মাণে সে দিন যে প্রয়োজন ছিল, তা কি পুরুষ সম্পাদক-সঙ্কলকের হাতে মেয়েদের মৌখিক গাথার আবিষ্কারে কোনও প্রভাব ফেলেনি?

১৯২১-২২, চিত্তরঞ্জন দাশের কারাবাসকালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভানেত্রী হলেন বাসন্তী দেবী। ঊর্মিলা দেবী ‘নারী কর্ম মন্দির’ গড়ে মেয়েদের মধ্যে চরকা কাটা, তাঁত জনপ্রিয় করে তুললেন। ঢাকার আশালতা সেনও মেয়েদের সংগঠন খুললেন। নেত্রী হিসেবে উঠে এল হেমপ্রভা মজুমদার, জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। ‘ভদ্রঘরের গৃহবধূ’দের সঙ্গে হাত মেলালেন যৌনকর্মীরাও, মানদা দেবীর শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত বই থেকে জানা যায় তা। নারীর এই সচেতনতা ও তার পিছনে পুরুষের ভূমিকা, দুই-ই ছিল উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য।

ধরে নেওয়া যেতেই পারে, ১৯২৩ সালে প্রকাশিত মৈমনসিংহ গীতিকা’র গানগুলি তার বেশ কিছু বছর আগে সংগৃহীত। নারী-কবির রচিত নারী-চরিত্রদের মধ্যে ‘মলুয়া’ চরিত্রটি যেন এক গ্রাম্য সীতা। ‘গ্রেটার ট্র্যাডিশন’-এর রামায়ণে যখন রামকে দেবতা বা অতিমানব করে গড়া হচ্ছে, তখন এক আঞ্চলিক নারী কবি এমন এক চরিত্র তৈরি করছেন, তাঁর কাহিনির নিয়ন্ত্রণও নায়িকার হাতে। মলুয়া বিনোদকে প্রেমপ্রস্তাব দিচ্ছে, বিবাহে সক্রিয় হচ্ছে, কাজি ও দেওয়ানের লালসার বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করছে। শেষে সেও বিনোদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, দেওয়ান তাকে অন্যায় ভাবে আটকে রেখেছিল বলে। “ডুবুক ডুবুক নাও আর বা কত দূর।/ ডুইব্যা দেখি কতদূরে আছে পাতালপুর,” মলুয়ার আত্মনাশ মনে করিয়ে দেয় সীতার পাতালপ্রবেশকে।

চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যে পরিচিত রামায়ণ-রচয়িতা হিসেবে, যে রামায়ণ রাম নয়, সীতার আলোয় লিখিত। এই নারীমুক্তির চেতনায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে মিশিয়ে না দেখলে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা কি সম্ভব? ‘চন্দ্রাবতী’ নামের পালাটিতেও জেগে থাকে প্রেমে আহত হয়ে মেয়েটির রামায়ণ লেখার আশ্চর্য আখ্যান। এও কি এক আত্মশক্তির উত্থান নয় ?

মৌখিক সাহিত্যে যুগ কাল মিলেমিশে যাওয়াই ধর্ম। মৈমনসিংহ গীতিকা’র রচনাকাল অজ্ঞাত বলেই তার সংগ্রহ ও আবিষ্কারের কালে বিশ শতকের আলোকপ্রাপ্তা নারী-চরিত্ররা মিলেমিশে যেতে পেরেছে, একশো বছর পরে তা কি এক নতুন দিগন্ত দেখাতে পারে না?

অন্য বিষয়গুলি:

music Folk Songs
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy