—প্রতীকী ছবি।
ইদানীং ‘ফ্রিলান্সার’ শব্দটা আমাদের বেশ চেনা। তার উৎপত্তি খুঁজতে হলে পৌঁছে যেতে হবে আদি-মধ্যযুগের ইউরোপে। সেখানে ছিল ভাড়াটে যোদ্ধাদের দল— যে পক্ষ বেশি অর্থ দিত, তার হয়েই এরা বল্লম হাতে তুলত, পক্ষ নির্বাচনের জন্যে এরা কোনও মূল্যবোধ বা ভাবাদর্শের ধার ধারত না। যে কোনও পক্ষের হয়ে বল্লম হাতে তোলার অধিকার ছিল, তাই এরা ‘ফ্রি-লান্সার’। স্যর ওয়াল্টার স্কটের ১৮১৯ সালের আইভানহো উপন্যাসে শব্দটি প্রথম পরিচিতি পায়; তার পর ১৯০৩ সালে ঢুকে পড়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে।
আজকের ফ্রিলান্সারদের হাতে অবশ্য বল্লম নেই। তাঁরা নির্দিষ্ট কোনও সংস্থায় স্থায়ী চাকরির বদলে স্বাধীন ভাবে এক বা একাধিক সংস্থায় কাজ করেন, এবং বাঁধাধরা মাসমাইনের বদলে ঘণ্টাপিছু বা কাজপিছু নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পান। এই ধরনের কাজের এখন নাম ‘গিগ’। এই শব্দটারও ইতিহাস আছে। অতীতে গীতিবাদ্যকাররা নগদ অর্থের বিনিময়ে, স্বাধীন ভাবে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন, তাকে বলা হত ‘গিগ’।
গিগ শ্রমের বাজারে কাজ করার কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, সবচেয়ে বড় সুবিধা হল নিজের পছন্দমতো কাজ নিজের সুবিধামতো সময়ে করার স্বাধীনতা। অবশ্য, গিগ অর্থনীতির বাস্তব সাক্ষ্য দেবে যে, যাঁরা এই বাজারে কাজ খুঁজে নিচ্ছেন, তাঁদের কাছে এই স্বাধীনতার চেয়ে অনেক জোরালো কারণ রয়েছে— সর্বপ্রথম কারণ হল, স্থায়ী চাকরির ঘোর অভাব। এ ছাড়াও আছে নিজের পছন্দমতো কাজ না পাওয়া, কিংবা চাকরির অসহ চাপ, উপরওয়ালার দুর্ব্যবহার, এবং সর্বোপরি চাকরি চলে যাওয়ার নিরন্তর ভয়।
চাকরি চলে যাওয়ার ভয়াবহ বাস্তব চিত্র আমরা দেখেছি কোভিডকালে। সিএমআইই-র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের শুধু এপ্রিল মাসেই ভারতে বারো কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষ কর্মহারা হন। বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ-এর ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মহারা মানুষদের এক বড় অংশ গিগ অর্থনীতিতে যোগ দিচ্ছেন, এবং ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। ভারতে ২০২১ সালে যেখানে গিগ অর্থনীতির সঙ্গে মাত্র ৮০ লক্ষ মানুষ জড়িত, সেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে তা দু’কোটি ৪০ লক্ষ ছাড়াবে। নীতি আয়োগের হিসাবও একই কথা বলছে।
এখনও কিন্তু এ দেশের কর্মক্ষেত্রে গিগ কর্মীদের জন্য প্রায় কোনও আইনানুগ ব্যবস্থাই চালু করা যায়নি। এমনকি, ২০১৯ সালে তৈরি বেতনবিধি অনুসারে ‘ন্যূনতম মজুরি’র ব্যবস্থাটিও কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি। একটা উদাহরণ দিই। খাদ্য সরবরাহ, খুচরো পণ্য সরবরাহ, যাত্রী পরিবহণের মতো ক্ষেত্রে— অর্থাৎ ভারতের গিগ অর্থনীতি এখন যে ক্ষেত্রগুলিতে ঘনীভূত— সেখানে ১২টি বৃহৎ ই-কমার্স সংস্থার উপরে সমীক্ষা করে ফেয়ার ওয়ার্ক ইন্ডিয়া নামক একটি সংস্থা তাদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে জানায় যে, মাত্র পঁচিশ শতাংশ বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থা তার গিগ কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি দিচ্ছে। কর্মক্ষেত্র থেকে কোনও সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার প্রশ্নই নেই।
অবশ্য, এ ছবি শুধু ভারতের নয়। গিগ কর্মীদের কাজ সম্পর্কে বিশদে জানার জন্য জেমস ব্লাডওয়র্থ নামে ইংল্যান্ডের এক সাংবাদিক নিজেই একটা গোটা বছর গিগ কর্মী হিসাবে কাজ করেন। প্রথমে যোগ দেন এক বহুজাতিক পণ্য পরিবহণ সংস্থার গুদামঘর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে। ঠিক হয়, ঘণ্টাপিছু মজুরি পাবেন। যত ঘণ্টা কাজ, তত টাকা মজুরি। কিন্তু মাসের শেষে দেখা গেল, যা মজুরি পাওয়ার কথা, হাতে এল তার চেয়ে অনেক কম। ব্লাডওয়র্থ জানতে পারলেন, কাজের মধ্যে যে সময়টুকুর জন্যে তিনি শৌচালয় গেছেন, সেই সময়ের টাকাও মজুরি থেকে সমানুপাতিক হারে কেটে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই মজুরির টাকাতেই বেশির ভাগ কর্মীর সংসার চলে— ফলে, তা কাটা গেলে ভারী বিপদ। ব্লাডওয়র্থ লক্ষ করলেন, কাজের সময় তাঁর সহকর্মীরা জল খাওয়াই কমিয়ে দিয়েছেন। এর কিছু দিন পর গুদাম ঘরেরই একটি তাকে তিনি মূত্রপূর্ণ একটি বোতল দেখতে পান। বাথরুমে যাওয়ার জন্য পাঁচ মিনিট সময়ও যাতে নষ্ট না হয়, তার ব্যবস্থা। তবুও মাসের শেষে ঠিক সময়ে মজুরি মিলত না। এমনকি বড়দিনের মতো উৎসবের মাসেও না।
বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা অর্চনা আগরওয়াল (নাম পরিবর্তিত) কোভিডের সময় থেকে একটি অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে রান্না করা খাবার পাঠাতেন বাড়ি বাড়ি। আচমকাই এক দিন সকালে ফোনে মেসেজ এল, সংস্থাটি তাঁর থেকে আর পরিষেবা নেবে না। খোঁজখবর করে জানতে পারলেন, এক ক্রেতা তাঁর খাবার সম্বন্ধে অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির কাছে। আর কিছুই জানতে পারলেন না তিনি— ভুল শুধরানোর একটা সুযোগও পাবেন না কেন, কোন খাবারে কী সমস্যা হল, সে বিষয়ে সংস্থা তাঁর সঙ্গে এক বারও কথা বলল না কেন, উত্তর মিলল না কোনও প্রশ্নেরই।
পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা মালা ভৌমিক (নাম পরিবর্তিত) অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে একটি সর্বভারতীয় সংস্থায় বিউটিশিয়ান হিসাবে যোগ দেন। কাজপিছু মজুরি, তাই যত বেশি সম্ভব পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করতেন মালা। এক দিন কাজ এল সন্ধ্যা সাতটায়, বাড়ি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। সংস্থা কথা দিল, ফেরার সময় গাড়ি পাঠানো হবে। রাত এগারোটায় কাজ শেষ হওয়ার পর অবশ্য সংস্থার কেউ ফোনই ধরলেন না, গাড়িও এল না।
ভেবে দেখলে, পুঁজিবাদ চিরকাল যেমন শোষণের পথে হেঁটেছে, গিগ অর্থনীতির দুনিয়াতেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। গিগ কর্মীরা সংস্থার মুনাফার ভাগ পান না বটে, কিন্তু সংস্থার ক্ষতির ভার বহন করেন। সংস্থার নিয়মনীতি মানার দায় তাঁদের সবচেয়ে বেশি হলেও, নীতি-নির্ধারণ সমিতিতে তাঁদের কোনও উপস্থিতিই নেই। একই কাজের জন্যে মহিলা গিগ কর্মীদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম। গিগ কর্মীরা যে-হেতু ফ্রিলান্সার, সংস্থার কর্মী নন, তাই তাঁদের ছাঁটাই করতেও কোনও সমস্যা হয় না।
শুধু গিগ অর্থনীতি-কেন্দ্রিক শ্রমবাজারই নয়, সময় যত এগোচ্ছে, এ দেশের সম্পূর্ণ শ্রমের বাজারটিই ক্রমশ চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী কর্মচারী-কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। গোটা শ্রমের বাজারটিই হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অসুরক্ষিত। সেখানে কাজটুকু টিকিয়ে রাখাই শ্রমিকের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়; কর্মী-স্বার্থ, সুরক্ষা বা কাজের পরিবেশ নিয়ে ভাবনার অবকাশ তৈরি হয় না। ভারতের শ্রমের বাজারের এই সার্বিক পরিবর্তন গিগ শ্রমের বাজারের ‘কাসকেডিং এফেক্ট’-এই কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
জনবহুল দেশে ব্যক্তিশ্রমের মূল্য সর্বদাই কম। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শ্রমের বাজার যদি সস্তার পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অনিশ্চিত এবং অসুরক্ষিত হয়ে দাঁড়ায়, তার সার্বিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কী হবে, সে কথা ভেবে দেখার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy