—প্রতীকী চিত্র।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফর নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। বিভিন্ন জায়গায় বলা হচ্ছে যে, ভারতের যত না আমেরিকাকে প্রয়োজন, আমেরিকার ভারতকে প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। কারণ, আমাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং চিনের সঙ্গে আমেরিকার আপাত-দূরত্ব। বিদেশি সাংবাদিকরা এ কথাও বলেছেন যে, ভারতের অর্থনৈতিক প্রগতির অনেকটাই নরসিংহ রাও এবং মনমোহন সিংহ-কৃত আর্থিক সংস্কারের হাত ধরে হলেও কংগ্রেস সেই কথাটি মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে পরিকাঠামোজনিত বিনিয়োগ অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অসহিষ্ণু আক্রমণাত্মক ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেওয়া, এ সব মেনে নিয়েও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি যে উজ্জ্বল, সে কথাটাই বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে।
ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা বা তার বিদেশজোড়া খ্যাতি সামগ্রিক জাতীয় আয়ের হিসাবে। জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি আপেক্ষিক ভাবে নিম্নবিত্ত নাগরিকেরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েন সেটা অধোগতির লক্ষণ। পশ্চিমের অনেক বড় বড় নামকরা অর্থনীতিবিদ এক কালে এই কথাটাই বলে এসেছেন। কিন্তু ভারতের মাথাপিছু আয় পৃথিবীর একেবারে তলানির দিকে কেন? মানবিক উন্নয়ন সূচকের নিরিখে কিংবা অপুষ্টি এবং ক্ষুন্নিবৃত্তিজাত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতেও আমাদের খামতি চোখে পড়ার মতো। জাতীয় আয়বৃদ্ধির উচ্চ হার নিঃসন্দেহে দরিদ্র জনগণকে খানিকটা সাহায্য করেছে, না হলে স্বাধীনতার সময় প্রায় ৭৫ শতাংশ দারিদ্রের হার আজ ২৫ শতাংশের কাছে গিয়ে দাঁড়াত না। ইউনাইটেড নেশনস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর হিসাব বলছে, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৯-২১ অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতের প্রায় ৪১ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক সূচকের নিরিখে দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ক্রমাগত আপেক্ষিক রোজগারের ভিত্তিতে পিছিয়ে পড়েছেন।
ভারতের অর্থনীতির মূল ক্ষমতার আধার পরিষেবাভিত্তিক প্রগতি। পৃথিবীর কোনও দেশে গত তিন দশকে পরিষেবা ক্ষেত্র বছরে গড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি হারে বৃদ্ধি পায়নি। অন্য দিকে, ভারতের এমন কোনও শিল্পজাত ব্র্যান্ড নেই যাকে এক ডাকে পৃথিবীর মানুষ চিনে ফেলে। কী কৃষি, কী শিল্প, উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বৃদ্ধির হার এবং উৎপাদনশীলতা বেশ নড়বড়ে। মাথাপিছু আয় কম হওয়ার একটা বড় কারণ ভারতে অপ্রশিক্ষিত, অদক্ষ তরুণের সংখ্যা বিপুল। পশ্চিমে এখন চরম শ্রমিকসঙ্কট, ফলে ভারতের এই তরুণ জনসংখ্যাকে তারা ‘সম্পদ’ হিসাবে দেখে। সত্যি কথা হল, ভারতে এঁদের আয় করার সাধ্য এবং সম্ভাবনা অতি সীমিত। তাই আমাদের মাথাপিছু আয় দরিদ্র দেশের মতো।
চিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন যে স্তরে গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি হয়ে চলেছে, তা আমেরিকার কাছাকাছি। ভারতে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ খাতে খরচ এবং তার ফলাফল কহতব্য নয়। তবে, নিজেদের সব সময় সব বিষয়ে গবেষণা করতে হবে, সেটা স্বল্পবিত্তের দেশে বাস্তবোচিত দাবি নয়। ভারত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে সুনাম অর্জন করেছে সেটা গবেষণালব্ধ নয়— অন্যের গবেষণাকে ব্যবহার করে।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, আমরা আমেরিকার চেয়ে মোটামুটি দশ-এগারো ঘণ্টা এগিয়ে থাকি বলে ভার্চুয়াল কাজকর্মের খুবই সুবিধা হয়। আমেরিকা যখন ঘুমোতে যায় আমরা তখন জেগে উঠি, উল্টোটাও সত্যি। তাই কম্পিউটারের মাধ্যমে এক দেশে করা অসম্পূর্ণ কাজ রাতারাতি অন্য দেশের কর্মীরা করে ফেলতে পারেন। ব্রিটিশদের শেখানো ইংরেজি ভাষার জয়জয়কার। ব্যবসায়িক কথোপকথনে, লেখাপড়ায় এর জুড়ি নেই।
জাতীয় আয়ে ভোগব্যয়ের অনুপাত চিনের চেয়ে ভারতে অনেক বেশি। অর্থাৎ, চিন মূলত সঞ্চয় করে আর ভারত বেশি খরচ করে। অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তক যে দিন থেকে লেখা শুরু হয়েছে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনও ইতিহাস হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একটি দেশ ভারতের মতো এত কম হারে সঞ্চয়-বিনিয়োগ করে এর বেশি হারে জাতীয় আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত দুই দশকে এবং তার আগেও ভারতে গড় বিনিয়োগের হার জাতীয় আয়ের অনুপাতে চিনের চেয়ে প্রতি বছর প্রায় ১৫ শতাংশ-বিন্দু করে কম। এর মানে হল ১০০ টাকায় চিন যদি ৫০ টাকা বিনিয়োগ করে আমরা ৩৫ টাকাও করি না। বিনিয়োগ ছাড়া আয়বৃদ্ধি হয় না বলে আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি— ভারত তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। দশ একর জমি জোগাড় করে শিল্প তৈরি করতে এ দেশে দশ বছরেরও বেশি লাগতে পারে, কিন্তু দশ তলা বাড়ি তৈরি করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলার রোজগার করাটা সম্ভব। বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হয়নি এ দেশে। হিসাব বলে, সরকারি সামগ্রিক বিনিয়োগের হার বিশ বছর ধরে জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশের কাছাকাছি আর বেসরকারি বিনিয়োগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওই সময়ে ৩% বেড়েছে— চিনে বেড়েছে দশ শতাংশের বেশি। এ দেশে তথ্য নিয়ে বড়াই করা বিভিন্ন ঘোষণার সময় বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসাবে কত সেটা আর দেওয়া হয় না। ১০০ টাকায় ১ টাকা বিনিয়োগ আর ৫০০ টাকায় ২ টাকা বিনিয়োগ মানে কিন্তু বিনিয়োগের হার কমে গেল।
বিশ্বে অনাবাসী ভারতীয়দের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং তাঁদের মধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রভূত জনপ্রিয়তার কথা হচ্ছে। এ দেশেও শুনেছি কর্নাটকের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বেঙ্গালুরু শহরের ধারে-কাছে কেন্দ্রীয় শাসক দলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। আমরা জানি, আমরা যে বৃত্তে মেলামেশা করি সেই বৃত্তে আমার ভাবমূর্তি যত উজ্জ্বল হবে তত আমার ভাল লাগবে। আমাদের সকলের জীবনেই ভাল লাগার উপাদান বা ফিল গুড ফ্যাক্টরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভিতরে যদি গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ন কিছুটা কম হত, মাথাপিছু আয় বেশ খানিকটা বাড়ত, কিন্তু সামগ্রিক জাতীয় আয় তেমন বাড়ত না। ধরা যাক ৪% হারে বৃদ্ধি পেত, আমরা পৃথিবীর প্রথম দিকের দশম দেশ হতাম। যদি চিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভাল থাকত তা হলে তাদের আর ভারতকে দরকার হত না। তা হলে অনাবাসী এবং এখানেও যাঁরা আমেরিকার অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শনে খুব আহ্লাদিত, তাঁদের ঠিক কেমন লাগত? উত্তরটা আমাদের জানা।
বহু উচ্চশিক্ষিত, সফল পেশাদার মানুষ, দেশের ভিতরে এবং বাইরে ধর্মীয় ব্যাপারে ভয়ঙ্কর অসহিষ্ণু মনোভাবের পরিচয় দেন। অনাবাসী বা ভারতবাসী, যিনিই হোন না কেন, অর্থ প্রতিপত্তি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার উপলব্ধি মানুষকে অন্ধ করে। মানুষ যা ভাবতে ভালবাসে না, যা দেখতে চায় না, যে সমস্যা তারা মনে করে গৌণ, সেটাই অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই দিনের শেষে কখনও কখনও একা আয়নার সামনে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আমেরিকার আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানানো আমাকে ভারতবাসী এবং ভারতের নাগরিক হিসাবে গর্বিত করেছে। কিন্তু পুরনো এবং নতুন অনেক প্রশ্ন আমাদের করে যেতেই হবে, সেটাও প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy