Advertisement
E-Paper

সুরক্ষিত গর্ভপাতের অধিকার

এই কুড়ি-চব্বিশ বিভাজনের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটটি না জেনে নারী অধিকার উদ্‌যাপনের ডঙ্কা বাজালে পূর্ববর্তী আইন-প্রণেতাদের প্রতি অবিচার করা হবে।

গর্ভপাতের অধিকার।

গর্ভপাতের অধিকার।

দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৫৪
Share
Save

গর্ভপাতের মতো একান্ত ব্যক্তিগত, পর্দার আড়ালে থাকা এক বিষয় মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ফের সংবাদ-শিরোনামে। গত জুন মাসে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত নারীর গর্ভপাতের অধিকারে লাগাম পরিয়েছিল। আর সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় নারীর ইতিমধ্যে স্বীকৃত এই আইনি অধিকারকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করল— অবিবাহিতার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নারীকেই সুরক্ষিত গর্ভপাতের বিষয়ে সমান অধিকার দিল। বিবাহিতের বেলায় গর্ভাবস্থার ২৪ সপ্তাহ, কিন্তু অবিবাহিতের ক্ষেত্রে ২০— গর্ভপাতে সময়সীমার এই পার্থক্য তুলে দিয়ে সকলের জন্যই ২৪ সপ্তাহের সীমা বৈধ হল।

এই কুড়ি-চব্বিশ বিভাজনের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটটি না জেনে নারী অধিকার উদ্‌যাপনের ডঙ্কা বাজালে পূর্ববর্তী আইন-প্রণেতাদের প্রতি অবিচার করা হবে। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুসারে, গর্ভস্থ ভ্রূণ যত দিন মায়ের শরীরের বাইরে স্বাধীন ভাবে বাঁচার ক্ষমতা অর্জন না করছে, তত দিনের মধ্যে যদি গর্ভ নষ্ট হয়, তা সে স্বাভাবিক বা ডাক্তারি হস্তক্ষেপ যে ভাবেই হোক, তাকে গর্ভপাত বলে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুবিধার কথা মাথায় রেখে আধুনিক হিসেবে এই সীমা ২৮ সপ্তাহ। এর পরেও ‘মিসক্যারেজ’ হতে পারে, কিন্তু তাকে গর্ভপাত না বলে অপরিণত প্রসব বলা হবে। চিকিৎসাশাস্ত্র ২৮ সপ্তাহকে সীমা হিসাবে ধরলেও মূলত মায়ের সুরক্ষার কথা বিচার করে কৃত্রিম গর্ভপাতের আইনি সীমা দেশ-কাল ভেদে আলাদা। আমাদের দেশে প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত যে কোনও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করা যেতে পারে; কিন্তু তার পরে করাতে গেলে বাড়তি সাবধানতা আরোপ করে আইন বলছে, অন্তত দু’জন স্বীকৃত চিকিৎসকের সায় দরকার, এবং সেই ক্ষেত্রেও সীমা ২০ সপ্তাহের মধ্যে বেঁধে দেওয়া।

সব দিক বিবেচনা করে এই প্রায়-সর্বসম্মত বাঁধন দেওয়ার পর কিছু বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হল। দেখা গেল যে, আধুনিকতম প্রযুক্তি গর্ভস্থ ভ্রূণের অনেক ত্রুটি নির্ভুল ভাবে ধরে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কিছু মারাত্মক ত্রুটি— বিশেষত মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি, ভ্রূণের ২০ সপ্তাহের আগে ঠিক ভাবে ধরতে পারছে না, যথেষ্ট নির্ভুল ভাবে পারছে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে। সুতরাং যদি ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ ভ্রূণের এমন কোনও ত্রুটি নির্ণীত হয়, যাতে জন্মগ্রহণের পর থেকে আজীবন তাকে গুরুতর শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা বয়ে বেড়াতে হবে, আমৃত্যু কাটাতে হবে পরনির্ভর হয়ে, তা হলে সেই নিরাময়-অযোগ্য ভ্রূণকে মোচন করাই কাঙ্ক্ষিত— না-জন্মানো সেই মানুষটি, তার হবু মা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব দৃষ্টিকোণ থেকেই। তাই ২৪ সপ্তাহ অবধি আইনের এক বিশেষ শিথিলতা আনা হয়েছে: এতটা পরিণত ভ্রূণ নষ্ট করতে গিয়ে মায়ের সম্ভাব্য শারীরিক ক্লেশ সামলে দেওয়া যাবে, চিকিৎসকরা সে বিষয়ে অনুকূল মতামত দিলে ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করানো যাবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীই যে হেতু সন্তান ধারণ করেন, তাই এই আইনি শিথিলতা প্রাথমিক ভাবে দেওয়া হয়েছিল শুধু বিবাহিতাদেরই। কিন্তু আমাদের দেশ একক মা-কেও আইনি স্বীকৃতি দেয়। সুতরাং, অসুস্থ ভ্রূণ সংক্রান্ত একই যুক্তিতে তাঁদের জন্যও এই সুযোগকে প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত ছিল সময়ের দাবি। সুপ্রিম কোর্ট তাকে সম্মান করেছে।

কিন্তু বর্তমান রায়টির গুণকীর্তন করতে গিয়ে তার এই চিকিৎসাশাস্ত্রসম্মত পরিপ্রেক্ষিতটি বিস্মৃত হয়ে অবিবাহিতার পুরুষ সঙ্গীর বিলম্বিত ‘পিছু হটা’ বা বিশ্বাসঘাতকতার কথা আলোচিত হচ্ছে। বুঝতে হবে যে, এই রায় সেই সঙ্কটের রক্ষাকবচ হতে পারে না। কারণ শুধু ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে নয়, অবিশ্বস্ত পুরুষ গর্ভাবস্থা আরও পরিণত হওয়ার পরেও দায়িত্ব বা পিতৃত্ব অস্বীকার করতে পারে। তার সমাধান গর্ভপাত নয়, সে জন্য অন্য আইন আছে।

এই রায়ের আর একটি অভিমুখ— বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে গর্ভপাত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যে সেই নারীর নিজের ও একমাত্র তাঁরই, ভারতে বলবৎ এই আইন আরও স্পষ্ট করে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এখানে উল্লিখিত হয়েছে। জরায়ু যাঁর, তিনিই স্থির করতে পারেন সেখানে গর্ভ ধারণ করবেন কি না, এটি খুব সহজ স্বাভাবিক যুক্তি। কিন্তু তাকে বাঁকিয়ে দেওয়ার জন্য সদা জোট বেঁধে প্রস্তুত সমাজ, ধর্মীয় ভাবাবেগ, পুরুষতান্ত্রিকতা। আমাদের স্বস্তি, ভারতের ন্যায়ালয় ‘স্বাভাবিক’ যুক্তিকেই শিরোধার্য করেছে। এমনকি বৈবাহিক ধর্ষণের সমস্যার কথাও প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছে। মাসকয়েক আগে গর্ভপাত বিষয়ে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা ও এই রায় নিয়ে গর্ব হয়।

শুধু একটি আক্ষেপ, জন্মনিয়ন্ত্রণের নানা কার্যকর, সুলভ ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্তরে সকল প্রাপ্তবয়স্ক দেশবাসী এবং সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্র আরও সচেতন হলে বহু অবাঞ্ছিত গর্ভ ও গর্ভপাত এবং তজ্জনিত শারীরিক ও সামাজিক সঙ্কট এড়ানো যায়, এই চেতাবনিটুকু যদি এই ৭৫ পৃষ্ঠার রায়ে কোথাও উল্লেখ থাকত!

Abortion Women India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।