Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus in India

বিসর্জনের অন্ধকার

যে ভারতে মেয়েরা যুদ্ধবিমান চালাইতে পারেন, সেই ভারতেই আবার অসংখ্য মেয়ে প্রায় প্রতি রাত্রে মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খান, পণপ্রথার বলি হন, গণধর্ষণের পর জ্বলিয়া মরেন। এই সমাজ দেবীপূজা করিতে পারে।

সংগৃহীত।

সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২০ ০১:১৬
Share: Save:

কর্তব্যনিষ্ঠ। মোদীনগরের সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট সৌম্যা পান্ডে সম্পর্কে এই কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি সন্তান প্রসবের দুই সপ্তাহের মধ্যেই সদ্যোজাতকে সঙ্গে লইয়া কাজে যোগ দিয়াছেন। বরাদ্দ ছয় মাসের ছুটি নেন নাই। অবশ্য, তাঁহার কাজটিও সামান্য নহে। এই বৎসর জুলাইতে তাঁহাকে গাজ়িয়াবাদ জেলার কোভিড বিভাগের নোডাল অফিসার নিযুক্ত করা হইয়াছিল। অর্থাৎ, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও তিনি অতিমারির ঝড় সামলাইয়াছেন। এবং সন্তানের জন্ম তাঁহাকে নিজ কর্তব্যবোধ হইতে কিছুমাত্র বিচ্যুত করিতে পারে নাই। তাঁহার যে ছবিটি সমাজমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হইয়াছে, তাঁহাতে দেখা গিয়াছে তিনি ফাইলপত্র দেখিতেছেন, ক্রোড়ে শিশুটি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাইতেছে।

এই ছবিটি আধুনিক ভারতের নারীশক্তির চমৎকার বিজ্ঞাপন হইতে পারিত। বিশেষত এই লগ্নে, যখন দশভুজার আরাধনায় দেশবাসী ব্যাপৃত। ভয়াবহ অতিমারি পরিস্থিতিতে এক শিশুকে সঙ্গে লইয়া সদ্যপ্রসূতির কাজে যোগদান আদৌ উচিত কি না, তাহা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে। কিন্তু তাঁহার সদিচ্ছা লইয়া প্রশ্নের অবকাশ নাই। তাঁহার বক্তব্য হইতেই স্পষ্ট, তিনি পরিস্থিতি এবং নিজ পদের গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত। অতিমারি চলিতেছে। এই অবস্থায় ছয় মাস তিনি গৃহবন্দি হইয়া থাকিলে যে দায়িত্ব তাঁহার উপর ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা হয়তো যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হইত না। আবার সন্তানের প্রতি নূতন মায়ের কর্তব্যটিও অবহেলা করিবার নহে। সুতরাং, তিনি উভয় কর্তব্যের মধ্যে ভারসাম্যের এক সুন্দর রূপরেখা টানিতে চাহিয়াছেন। এমন নিদর্শন কোভিড-পরিস্থিতিতে আরও দেখা গিয়াছে। যে মহিলা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মীরা এই মহা বিপর্যয়েও নিয়মিত পরিষেবা দিয়া আসিতেছেন, তাঁহারাও কাহারও মা, কন্যা, স্ত্রী। তাঁহারাও কেহ দীর্ঘ দিন গৃহে ফিরিতে পারেন না, ফিরিলেও সন্তানকে কোলে লইতে পারেন না, অসুস্থ মায়ের পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারেন না, পাছে তাঁহারাও সংক্রমিত হইয়া যান, এই ভয়ে।

ইহা তো গেল অতিমারির কথা। স্বাভাবিক সময়েও মেয়েদের এই অপরিসীম কর্তব্যবোধটি কি চোখে পড়ে না? না পড়াই অস্বাভাবিক। অন্তঃসত্ত্বাই হউন, কিংবা অসুস্থ— সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি কার্যে তাঁহারা অটল থাকেন। জীবিকার প্রয়োজনে গৃহের বাহিরেও পা রাখেন। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে তাঁহাদের উভয় দিকের ভারসাম্য বজায় রাখিতে হয়। গ্রামীণ ভারতে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও মেয়েরা খেতে চাষের কাজ করিতেছেন, বা পানীয় জল দূর হইতে বহিয়া আনিতেছেন— এমন দৃশ্য আদৌ দুর্লভ নহে। তাহা সত্ত্বেও মেয়েদের যথাযোগ্য সম্মান ভারতীয় সমাজ দিতে পারিল কই? এখনও তো সমাজের সর্বস্তর হইতে তাঁহাদের দুর্বল, ভোগ করিবার সামগ্রী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রের ন্যায় পরিচয়গুলি ঘুচিল না। যে ভারতে মেয়েরা যুদ্ধবিমান চালাইতে পারেন, সেই ভারতেই আবার অসংখ্য মেয়ে প্রায় প্রতি রাত্রে মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খান, পণপ্রথার বলি হন, গণধর্ষণের পর জ্বলিয়া মরেন। এই সমাজ দেবীপূজা করিতে পারে। কিন্তু রক্তমাংসের দুর্গারা অনেকাংশেই উপেক্ষিত থাকিয়া যান। তাই সৌম্যা পান্ডের ছবিটি নারীশক্তির মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে পারে না। বিসর্জনের অন্ধকার এখানে বড়ই প্রকট।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in India IAS
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy