তৎপর: নাগরিক, স্বাস্থ্যকর্মী বা সরকারি আধিকারিক, কেরলে প্রত্যেকেই নিজের দায়িত্বের কথা জানেন এবং তা পালন করেন। ছবি: এএফপি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন আলো নিভিয়ে এবং আলো জ্বালিয়ে নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবাইকে এককাট্টা হতে উদ্বুদ্ধ করছেন, সেই মুহূর্তেই কেরলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত এক বরিষ্ঠ দম্পতি— যাঁদের এক জনের বয়স তিরানব্বই আর অন্য জন ছিয়াশি— হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন ২৩ দিন পর। এঁরা সংক্রমিত হয়েছিলেন ইতালি-ফেরত সন্তানের মাধ্যমে। করোনাক্রান্ত বিশ্বের যে কোনও দেশেই এমন ঘটনা বিরল। বিরল, কিন্তু অলৌকিক নয়। এই ঘটনা ও সেই সঙ্গে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠার নিরিখে কেরলের সবার থেকে এগিয়ে থাকাই দেখিয়ে দেয় জনস্বাস্থ্য বিভাগে রাজ্যটির আশ্চর্য রকম পূর্বপ্রস্তুতি। কেরলে এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ সুস্থ হয়ে উঠেছেন, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় যা অনেক বেশি। যে রাজ্যে প্রথম আক্রান্ত চিহ্নিত হয় ৩০ জানুয়ারি, সেখানে এখনও করোনা-সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র তিন। এগারো হাজারেরও বেশি মানুষের থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।
কোভিড-১৯-এর নিয়ন্ত্রণে কেরলের এই আপেক্ষিক সাফল্যের কারণ কী? অবশ্য এখনই একে ‘সাফল্য’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে। একটু পিছিয়ে যাই। ৩০ জানুয়ারি কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্রীমতী শৈলজা যখন কেরলের তথা ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা রাজ্যবাসীকে জানালেন, কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওষুধের দোকানগুলিতে মুখোশ কেনার ভিড় জমে গেল। পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়ই, দেশের প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত চিহ্নিত হন কেরলের ত্রিশূরে। চিনের উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। ২৪ জানুয়ারি বাড়ি পৌঁছে তিনি কালবিলম্ব না করে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলেন। তখনও কিন্তু তাঁর সংক্রমণের কোনও বাহ্যিক লক্ষণ দেখা দেয়নি, এবং এয়ারপোর্টেও কেউ কিছু বলেননি। ডাক্তারবাবু পরামর্শ দেন রোগলক্ষণ দেখা গেলেই জেলার রোগ-নজরদারি অফিসারকে ফোন করে জানাতে। আশঙ্কা সত্যি করে তিন দিনের মধ্যেই দেখা দিল গলাব্যথা। অতএব অফিসারকে ফোন এবং হাসপাতালে ভর্তি। রক্ত এবং লালারস পুণের পরীক্ষাগারে পাঠানো হলে ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেল।
এর মধ্যে অন্তত তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। কেরলে দীর্ঘ বসবাসের কারণে ও কেরলের উন্নয়ন ‘মডেল’ নিকট থেকে দেখার সুবাদেই হয়তো এ বিষয়গুলি দেখতে শিখেছি। এক, ছাত্রীটি রোগলক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও, ‘কই, এয়ারপোর্টে তো কেউ কিছু বলেনি’ বলে শপিং মলে ঘুরতে চলে যাননি। দুই, এক জন সচেতন নাগরিক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন স্তরের মানুষজন— প্রত্যেকেরই যেন তাঁদের নিজ নিজ ভূমিকা নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি বা দোদুল্যমানতা নেই। আর সে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সবজান্তা ঊর্ধ্বতনের বিরাগ বা অধস্তনের তাচ্ছিল্যের মুখেও সম্ভবত পড়তে হয় না তাঁদের। তিন, সব যে ভাবে এগিয়েছে এতটুকু কালক্ষেপ না করে, মনে হয় যেন এক সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্য। ১৮ জানুয়ারি যখন করোনাভাইরাস নিয়ে হু’র প্রথম সতর্কবার্তা এল, তৎক্ষণাৎ তাকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে কেরলের সমস্ত জেলার রোগ-নজরদারি টিমকে তাদের কর্তব্যকর্ম জানিয়ে দেওয়া হল। স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত প্রত্যেককে নজরদারি আর সংক্রমণ-যোগ চিহ্নিত করার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল। তাই চিন থেকে সে সময়ে ছুটিতে বাড়ি আসা প্রায় কয়েকশো মানুষের প্রত্যেককে নিয়মিত নজরে রাখাও সম্ভব হয়েছিল। এয়ারপোর্টেই বিশেষ সুরক্ষা-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হল। সামান্য জ্বরের লক্ষণ দেখলেই সোজা আইসোলেশনে। মনে রাখতে হবে, কেরল এমন এক রাজ্য যার প্রতিটি জেলায়, প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদেশ প্রত্যাগত মানুষ ঘরে ঘরে। তবু কোভিড-১৯ যে সেখানে ভয়াবহ চেহারা নেয়নি তার পুরোপুরি কৃতিত্ব কেরলের সমাজ-সংস্কৃতির। অবশ্যই সরকারেরও। সরকার তো আর সমাজ-সংস্কৃতি-বিচ্ছিন্ন কোনও পদার্থ নয়। সরকারের দক্ষতার ইঙ্গিত পেতে হলে স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটটিতে চোখ বোলালেই হবে। প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তমান সংখ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দেওয়া হচ্ছে সেখানে। আটকে পড়া পরিযায়ী এবং অন্য কাজ-হারানো শ্রমিকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থার বিস্তারিত হিসেবও নিয়মিত তুলে দেওয়া হচ্ছে।
গত বছর জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য-অর্থনীতি বিষয়ে এক কনফারেন্সে গিয়েছিলাম কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন রাজীব সদানন্দন, ডঃ জয়শ্রী আর ডঃ সাজিত। এঁরা কারা জানেন? রাজীব কেরল সরকারের স্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মুখ্য সচিব। জয়শ্রী কোঝিকোড জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক আর সাজিত সেখানকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার। ওঁরা নিপা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই ও যুদ্ধজয়ের গল্প শোনালেন, যে যুদ্ধে এই তিন জনের ভূমিকা কেরলবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় ২০১৮ সালে, মূলত কেরলের দুটি জেলায়। আক্রান্ত উনিশ জনের মধ্যে সতেরো জনকেই বাঁচানো যায়নি। কিন্তু সংক্রমণও আর ছড়ায়নি। কী ভাবে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, কী ভাবে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাতারাতি যোগাযোগ করে নিপার সদ্য আবিষ্কৃত অ্যান্টিবডির সাহায্যে ভাইরাসকে হারানো হল— তার রোমহর্ষক বর্ণনা শুনছিলাম। ওঁরা কিন্তু নিজেদের কৃতিত্ব ফলাও করে না বলে বার বার বলছিলেন সহযোগের গল্প। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তো তেমন যুদ্ধ নয়, যে যুদ্ধে থাকে শুধুই কম্যান্ডারের শক্তি প্রদর্শন। এ লোকশক্তির গল্প। যে লোকশক্তি নিপার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুত। অমর্ত্য সেনের সাম্প্রতিক রচনায়ও দেখলাম কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যুদ্ধের অনুষঙ্গ টেনে আনায় তাঁর ঘোরতর আপত্তি। যুদ্ধে থাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাবি। অমর্ত্য বলছেন সহযোগিতার কথা, আলোচনা-সমালোচনার কথা। যুদ্ধপরিস্থিতির অজুহাতে কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া চলে না।
ভারতীয় সংবিধানে স্বাস্থ্য বিষয়টি রাজ্য তালিকাভুক্ত, তাই স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থাপনার কাজটি মূলত রাজ্যের করার কথা। কিন্তু রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয় বলে কেন্দ্র দাদাগিরি করবে না, তা তো হয় না। অর্থের সিংহভাগের জোগান দেয় কেন্দ্র, যদিও সে অর্থ আদতে দেশবাসীরই, শাসকদলের পকেটজাত নয়। তবু কেন্দ্র দিচ্ছে না রাজ্য দিচ্ছে— এই নিয়ে এক নির্বোধ কুনাট্যে অকারণ শক্তিক্ষয় হতে দেখি নিরন্তর। এই দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক অর্থনীতির চক্করে সহযোগ বা যৌথ রসায়ন সুদূরপরাহত। যখন প্রয়োজন সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোকে উন্নত করতে আরও বিনিয়োগ, আর যে বিনিয়োগের জন্যে প্রয়োজন আরও অর্থের, তখনই উল্টো দিকে হেঁটে কেন্দ্র আয়ুষ্মান ভারত এনে ফেলে সরকারি পরিষেবার দফারফার ব্যবস্থা করল। আয়ুষ্মান ভারত মূলত চিকিৎসা বিমা, যার প্রিমিয়াম সরকার দিয়ে দেবে। যে সব পরিবার এতে অন্তর্ভুক্ত, তাদের যে কেউ হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা করালে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ বিমা থেকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মানে শুধুই চিকিৎসা তো নয়। স্বাস্থ্যসেবার অনেকটাই যাকে বলে নিবৃত্তিমূলক, অসুখ হতে না দেওয়া। পানীয় জল বা শৌচাগার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বিস্তার ঠেকানোও তার কাজ। জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন কোনও রোগের উদ্ভব হল কি না, তার নজরদারির জন্যে দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। রোগটি কী ভাবে ছড়ায়, মানবশরীরে তার কী রকম প্রভাব, এ সব জানতে গবেষণার প্রয়োজন। এপিডেমিয়োলজিস্ট থেকে পতঙ্গবিদ— সকলের গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। আর তার জন্য খরচা আছে। কেন্দ্র অবশ্য বলে থাকে, যা দিচ্ছি তা থেকেই বা জনস্বাস্থ্যখাতে খরচ হচ্ছে কই? কিন্তু লজ্জার কথা, কেন্দ্র এবং রাজ্য মিলে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়ের এক শতাংশের ওপরে ওঠেনি। বিশ্বের কোনও দেশই স্বাস্থ্য খাতে এত কম খরচ করে না। বিভিন্ন রাজ্যের ব্যয়ের মাত্রা বিভিন্ন। খুব ছোট কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে কেরলেই স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু ব্যয় সর্বাধিক। নিপা ঘটনার পরে কয়েক মাসের মধ্যেই রাজ্য সরকার তৈরি করে ফেলল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড ভাইরোলজি, পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির ওপর নির্ভরশীলতা দূর করতে। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কেরলের এগিয়ে থাকা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy