—ফাইল চিত্র।
সভ্যতার যাত্রাটাই যেখানে বাহুবল থেকে বাক্যবলের (বা মনোবলের) দিকে, বাইসেপের তাকত পেরিয়ে বুদ্ধি ও প্রতিভার ঝলমলানির দিকে, নিন্দুকেরা বলবে মুগুরের জোর পেরিয়ে টাকা ও ক্ষমতার জোরের দিকে, সোজা কথায় স্থূল শরীরকে অত পাত্তা না দিয়ে মস্তিষ্কের হরেক সূক্ষ্ম কেরদানিকে মহিমা-নৈবেদ্য সমর্পণের দিকে, সেখানে উৎপটাং অতিমারি এসে ‘ইমিউনিটি থাকলে বাঁচবে, নইলে বাঁচবে না’ ধাঁ-ঘোষণা করে, পূর্ণ চাকাটাকেই উল্টো ঘুরিয়ে ছেড়েছে। লকডাউন আজ নয় কাল উঠবেই, অফিস যেতে হবেই, লোকজনের সান্নিধ্যে আসতে হবেই, এবং ও মা ও পিসি ও শিবুদা তখন নাকি করোনা পরশু নয় তরশু খপাত পাকড়ে ধরবেই, এ বার দেহের ভেতরের অ্যান্টিবডিরা যুদ্ধ বাগাতে পারলে তুমি রইলে, নইলে ফৌত— এ কী ধরনের অশ্লীল ফরমান! এ তো আকাঁড়া সেই ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তনের তত্ত্ব, যা কতকগুলো আদিম হুমহাম বাঁদুরে লোমশ লোকের কালে চালু ছিল, যাদের ছবি আমরা জাদুঘরে দেখি আর মনের ভুরু কুঁচকোই। আমরা সভ্য, পরিশীলিত মানুষ, শুধু লিভার কিডনি ফুসফুস থেকে উৎসারিত প্রাণশক্তি দিয়ে আমাদের বিচার হবে না কি?
ঠিকই, শেষ অঙ্কে যখন খ্যাঁচাকলে ভর্তি হতে হয়, তখন নামজাদা ডাক্তাররা এসে ‘ওঁর শরীরের শক্তি থাকলে উনি লড়তে পারবেন, নইলে আর কী করা’ বলে উদাস চলে যান, আর বিশদ প্রশ্ন করলে আইসিইউ-এর ম্যাডামরা কড়কে দেন আর অন্তে পনেরো লাখ টাকা শুষে মৃতদেহটার হাত-পা বেঁধে কাগজে সিল করে হড়াস ডেলিভারি হয়, কিন্তু সে তো দীর্ঘ নাট্যের একদম প্রান্তিক স্টেশনের অবধারিত ছোঁচামি। তাতে মেজরিটি মনুষ্যের বিশ্বে প্রচারিত ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ নয়, বরং সম্পদই স্বাস্থ্য’ (সম্পদ মানে বস্তুগত ও ব্রেনগত দুইই, বা বলা ভাল ব্রেনশক্তিতে আয়ত্ত বস্তুগত সম্পদ) রটনা খুব খানিক টোল খায় না। জীবন-যোগ্যতা বলতে আমরা কক্ষনও বুঝিনি ইমিউনিটি, বা ইয়ো-ইয়ো টেস্টে ডবল প্রোমোশন, আমাদের শ্রেয়তার ধারণা বরং প্রখর ব্যঙ্গ-মুচকি নিয়ে তাকায় ডাম্বেল-সর্বস্বতার দিকে। নিশ্চয়, চিত্রকর পুশ-আপ দিয়েছেন, বক্সার ফিলসফি পড়েছেন, কিন্তু সর্বসম্মত ভাবে কৌলীন্য পেয়েছে একচিত্ত মগজচর্চা, প্রগতির দাঁড়িপাল্লা অতি গর্বিত ঢঙে কেতরে থেকেছে খুনখুনে, হাঁপানি সামলে ঘড়ি ঘড়ি আপ্তবাক্য আওড়ানো কবির অয়েলপেন্টিঙের পানে। মানুষ এগিয়েছে, সে কুকুরের থেকে আলাদা, ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের সৌষ্ঠব-শ্রেষ্ঠ চিতাবাঘের চেয়ে অভিজাত, কারণ সে বিশ্বাস করে ভাল মাইনে সে-ই পাবে, যার মাথা শনশন চলে। এখন দেখা যাচ্ছে, ‘হার্ড ইমিউনিটি’র চক্করে, সেরেফ ও একমাত্র শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা ঠিক করে দেবে আগামী ছ’মাসের মধ্যে ক-বাবু আদৌ বেঁচে থাকবেন কি না। বাঁচলে তবে তো প্রোটিন-বেতোয়াক্কা কঠিন কোটেশন! যদি এই ঢল মেনে, লোকে প্রেম করার সময় জিজ্ঞেস করতে শুরু করে ‘ইমিউনিটি আছে?’, যদি আম-পাবলিক ভেবে নেয় ইরম্মদময় ইমিউনিটি গড়ে তোলাই মানুষের মহাকর্তব্য, যদি অ্যারিস্টটল থেকে দিলীপ ঘোষ অবধি পাঁইপাঁই বহুবিচিত্র স্রোত অলীক ডিজিটাল ডিগবাজি খেয়ে ‘দাও ফিরে অন্তর্গত কুস্তিগিরটিরে’ প্রার্থনাধ্বনি ব্যাপ্ত করে এ নিখিলে, চমকাবে না পিলে?
অবশ্য অনেকের মত, বুদ্ধির থেকে ট্রফি কেড়ে মাংসপেশিকে দিতে হবে না, আগাগোড়া তার হাতেই ছিল, কিছু লোক হ্যালুসিনেট করছিল অন্যথা। তবে পরবর্তী প্রশ্ন, চলতি ধারণাটুকুই কি বদলাবে শুধু? তাইলে অসুবিধে বিশাল কিছু নেই, কারণ মূল্যবোধ দিয়ে জগৎ চলে না, চলে স্রেফ গড়গড়িয়ে চলার নেশাতেই। গ্লাভস পরে ভাত খাওয়ার সিন এই গতিজাড্যে ব্রেক কষে দেবে না তো? মাস্ক পরে যুবাযুবি চুমু খাবে, না চুমু উঠে যাবে শৃঙ্গারের চ্যাপটার থেকে? সবচেয়ে বড়, বাড়ির বাল্ব লো-ভোল্টেজ ঠেকলে মল-এ গিয়ে আলো পুইয়ে আসা জনসমষ্টি, রাস্তায় গাড়িঘোড়া দোকানপাট হকার-বেকার নয়ন ফেড়ে দেখতে দেখতে হাজার বছর ধরে হেঁটে সুখশ্বাস ফেলা জনপিণ্ড, হঠাৎ নেটফ্লিক্স-সর্বস্ব জেলকুঠুরি মেনে নেবে কি? করোনোত্তর বিশ্বে, যেথা দুর্গাপুজো হয় কম্পিউটার স্ক্রিনে, আর ভিলেন হিরোকে একটা ঘুসি মেরেই স্যানিটাইজ়ারে হাত ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আমরা কেমনে ফলব-ফুলব, বলো মা! উত্তর জলবৎ: ভয় নাই ওরে ভয় নাই, কিচ্ছুটি বদলাবে না। হ্যাঁ, মাস্কের ওপর আঁকতে হবে রাঙা স্মাইলি, গুটখা ছড়ানোর প্রিয়কার্যও কমতির দিকে, কিন্তু তা ছাড়া সমস্তই থাকবে হুবহু যেমনটি ছিল প্রি-করোনা যুগে। কারণ, মানুষ জীবটির কাছে মরে যাওয়া সবচেয়ে বড় দুর্দশা নয়, সর্বোচ্চ সর্বনাশ: বোর হওয়া।
সব কষ্ট সে সহন করতে পারে, হুপিং কাশি, প্রিয়জনবিয়োগ, এমনকি কলিগের পদোন্নতি, কিন্তু বন্ধুর কাঁধে ঢলে হ্যাহ্যা না করতে পারলে, রাস্তার দোকানে চা খেতে খেতে রাজনীতির হাড়শাঁস না ছাড়াতে পারলে, গলিতে অলস পায়চারি বা নিতান্ত পাঁচিলে কাঁকাল হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা না পোয়াতে পারলে, ক্যাফে রোল-দোকান ঝুপড়ি-স্টল ভরভর্তি করে গুটলি কাবাব লেড়ে বিস্কুটে মেখে ভিড়ের রইরই প্লাস পাশ-সঙ্গীর কলকল চুষতে না পারলে, তার বুকের ওপর মরা বাঘ শুয়ে যায়। শুধু একঘেয়েমির রাক্ষসকে ঠেলে চৌকাঠ পার করতে সে বিইয়েছে সঙ্গীত সাহিত্য সিনেমা, ব্যাগাটুলি থেকে পোল ভল্ট, কুম্ভমেলা থেকে পিকনিক, পর্নোগ্রাফি থেকে প্রণয়। মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য ভগবান পাওয়া বা চাঁদে যাওয়া নয়, একঘেয়েমি এড়ানো। আজ একটা ভিলেন রোগ এসে যদি তাকে বলে, বচ্ছর বচ্ছর ঘরে থেকে বোর হও, সে নিয্যস দাবড়াবে: ওই প্যান্তাখ্যাচাং বাঁচার চেয়ে ইন্টারভ্যালের আগেই মরা ভাল। মনে রাখতে হবে, ‘উহা ভাগাড়ের মাংস’ জানার পর মাস দেড়েক সে কিছুতে মাংস মুখে তোলেনি, হোটেলের হাহাকার থর মরুভূমি থেকে শোনা গেছিল, তার পরে মাংস না খাওয়ার বোরডম সইতে না পেরে ‘আরে ধুত্তোর, ফ্লেশ ইজ় ফ্লেশ, হোক না কুত্তোর’ রবে এমন হুমড়ি খেল প্লেটের ওপর, ললাটে এঁটো লেপে একসা। ফলে ডাঁয়েবাঁয়ে বডি পড়ছে দেখেও, মহাপ্রস্থানের মেন রোড স্বল্প ডজ করে মানুষ আর ক’দিনের মধ্যে বেরিয়ে পড়বে, মেলায় পাকাবে নাগরদোলা টিভিতে আইপিএল, আর প্যাঁচামুখো বিশেষজ্ঞদের ‘ভাতে ঘি-র সহিত দু-ড্রপ লিকুইড সোপ’-এর ওয়ার্নিংকে ভেংচি কেটে বলবে, জন্মিলে করোনা হবে, ইমিউনিটি থাকিলে খেলিব এ ভবে, এ জানার পরে আর বাড়ি বসে গুম-পাগলা হওয়ার কোশ্চেন উঠছে কোত্থেকে?
এক্সপার্টের মুখ আমসি-তর, কারণ তাদের ইমেজ প্রভূত তুবড়েছে। এই যুগে আমরা পেত্যয় গেছিলাম, প্রযুক্তি রিসার্চ জ্ঞানস্টক সাই-ফাই স্তরে উন্নীত, হপ্তা দেড়েকের মধ্যে ফাইভ-জি স্পিডে ওষুধ আবিষ্কার হয়ে যাবে, আমরা বাঁ হাতে টিকা নিতে নিতে ডান হাতে পিপিটি প্রস্তুত করব। হায়, টিভি ও মোবাইলে ঝুঁকে বিশেষজ্ঞরা দুরন্ত কপচেছেন, ভাইরাস কদমফুলের মতো দেখতে এবং বুধবার পমেটম মাখে, ব্রাজিল দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে স্পেন দিয়ে কুলকুচো, ইবোলাকে ভাই ডাকে প্যারাবোলাকে ভাতিজা, ক’পার্সেন্ট বাড়লে প্যানডেমিক কত ভগ্নাংশ কমলে অ্যাকাডেমিক, কিন্তু এ সবই হল বর্শাবিদ্ধ ছটফটিয়া সৈন্যকে বোঝানো, কী ভেলোসিটিতে এসে কোন অ্যাঙ্গলে বিঁধেছে এবং কেন বৃক্কের বাঁ দিকেই টাটাচ্ছে। ‘আমি কী করে সারব ডাক্তারবাবু’ আদি আকুতির উত্তরে বৈজ্ঞানিকের দল ঠোঁটশক্ত রামগরুড় 8.0, তার পর ধমকি-ধামকিতে ম্যানেজ করার চেষ্টা, অমন হাতে-গরম ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না কি, জানেন আগে বিলিতি ইঁদুরের ওপর টেস্ট করতে হয়, সে ইঁদুর যাতে না পালায় এস্পেশাল বেড়াল পালতে লাগে? সিধে কথা, হাত ধুয়ে হাজা করো মুখোশ পরে অরণ্যদেব সাজো, কিন্তু ইমিউনিটি থাকলে আছো, নইলে গনগনাগন। আসল মানে: বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভাগ্যে বিশ্বাস করো। ভগবান রাখলে, থাকবে। বেচারাদের অবস্থা দেখে হাসি পায়। ধর্মটর্ম সব নাকি ধুলোর নুটি, কুসংস্কারের ডাম্প, আর বিজ্ঞান হইল গিয়া ব্রেন-তকতক স্মার্ট পরিত্রাতা। সে ডাক্তারদের পোশাক পরাচ্ছে নভশ্চর মার্কা, রোবট গড়গড়াচ্ছে পেশেন্টের বেডের কাছে, ক’দিন পরে রোগীকে ড্রোন দিয়ে খুঁজবে ক্রেন দিয়ে তুলবে, কিন্তু বাপু হে, নিরাময়? ‘তব নিজ দেহে পালিছ স্নেহে।’ ভাল কথা, সেই অরণ্যেই যদি নির্বাসিত রোদন ও রিস্কের পসরা লয়ে, টিবি টাইফয়েড গেল তল করোনায় কিসের ভয় বল, আমাকে আমার মতো দাপিয়ে বাঁচতে দাও, ঠেসে বনগাঁ লোকালে বাদামভাজা খেতে খেতে যাই, ড্রপলেটের চেয়ে ট্রেন লেট আমাদের অধিক মাথাব্যথা। বলতে পারো, ‘ই কী, মিউটিনি!’ সে তো ‘কী ইমিউনিটি!’-রই অ্যানাগ্রাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy