ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
আজ ষষ্ঠী। পুজো পুরোদমে শুরু। বঙ্গজীবনে এমন আতঙ্কগ্রস্ত মহোৎসব আগে কখনও হয়েছে বলে জানা নেই। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ মহলের দৃঢ় ধারণা, উৎসবে ঢল নামলে পুজোর চার-পাঁচ দিন হবে ছবি শুরুর আগে ট্রেলার মাত্র! আসল ফিল্ম আসবে এর পরে। আর কার্যত আমরাই হব সেই জীবননাট্যের প্রযোজক, পরিচালক, কুশীলব এবং করুণ দর্শকও!
হাইকোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে কোনও আলোচনায় যাব না। তবে পুজোর বাজারে অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ের বহর দেখে একটা অনুমান করা যেতে পারে, নতুন জামা-জুতো-শাড়ি-সালোয়ারে সেজে দলে দলে প্যান্ডেল অভিযানে বেরোতে আমরা অনেকেই মানসিক ভাবে তৈরি! সে ক্ষেত্রে করোনার সঙ্গে করমর্দন করতে করতেই আমাদের এগোতে হবে!
যদি মূল মণ্ডপের কাছাকাছি যাওয়া না যায়, তাতেও দলে দলে রাস্তায় বেরোনোর হিড়িককে বাগ মানানো যাবে কি না, এটা বড় প্রশ্ন। এখানেই সমস্যা সবচেয়ে বেশি। কে না জানে, ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার। আর করোনাও সকলের সঙ্গে এ বার সেই উৎসবের শরিক। কিন্তু লোক বেরোতে থাকলে পুলিশ-মন্ত্রী-সিপাই-সান্ত্রি দিয়ে কত দূর করা সম্ভব?
ফলে নির্মম ভবিতব্যকে কেউ উপলব্ধি করতে পারুন বা না-পারুন, সতর্কতার ঘণ্টাটি বাজিয়ে যাওয়া এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি সামাজিক কর্তব্য। সেই ধ্বনি যাঁদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করবে না, তাঁরা কি সমাজের ‘শত্রু’ বলে গণ্য হবেন? সেটাও আজ ভেবে দেখার দিন।
বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালি উৎসবে মাততে সব সময়ই আগুয়ান। দোল-দুর্গোৎসবের মতো কিছু হলে তো কথাই আলাদা, সম্বৎসর আরও নানা উৎসব-অনুষ্ঠান বাঙালিকে নিয়ত উৎসাহের রসদ জোগায়। এখন তো পাড়ায় পাড়ায় কার্তিক পুজো, গণেশ পুজোও অনেক বেশি চোখে পড়ে।
একের পর এক পুজো ছাড়াও বড়দিন, পঁচিশে বৈশাখ থেকে শুরু করে নেতাজি ইন্ডোরের ফিল্মোৎসব বা নজরুল মঞ্চে গান মেলার মতো আরও অনেক কিছুকে বাঙালি গত কয়েক বছরের অভ্যাসে তার উৎসবের ক্যালেন্ডারে জায়গা করে দিয়েছে। আর এই সবের পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই ব্যাপারে তাঁর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে ইতিমধ্যেই সেটা স্পষ্ট।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার কাজ সচেতন ভাবেই শুরু করেছিলেন। এতে কোনও ভেদাভেদের ভাবনা তাঁর ছিল না। আজও নেই। বরং উদ্দেশ্য আমজনতাকে শামিল করা। রমজান মাসের ইফতার থেকে ইদের জমায়েত, পার্ক স্ট্রিটে ঝলমলে বড়দিনের কার্নিভাল, নেতাজি ইনডোর স্টোডিয়ামে বলিউড-টলিউড সমন্বয়ে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন বা রেড রোডে বিসর্জনের মহাসমারোহ— সবেরই লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ তৈরি করা। লোককে বোঝানো যে, এই খুশি তাঁদের প্রাপ্য এবং মমতার সরকার এসে সেটা করল। বস্তুত এমন ভাবনা থেকেই তিনি নিজে প্রতি বছর সাত-আট দিন ধরে ঘুরে ঘুরে দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেন।
তবে উৎসবের মতো রাজনীতিতেও বাঙালির খুব রুচি। মমতার উৎসব-প্রীতিকে রাজনীতির আঁচে সেঁকে নেওয়ার সমান্তরাল উদ্যোগও তাই থেমে থাকে না। থাকার কথাও নয়। যেমন বলা হয়, এগুলি তাঁর ভোট আদায়ের কৌশল। এর চেয়ে ‘সহজপাচ্য’ যুক্তি সত্যিই আর হয় না।
কথাটি যে একেবারে অসার, তা বলব না। রাজনীতিকেরা যে কোনও পদক্ষেপ করার আগে নিজেদের বিচারমতো অগ্রপশ্চাৎ ভাববেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এক পক্ষকে বিঁধতে গিয়ে অপর পক্ষ সচরাচর যা করে থাকে, সেটাও আলাদা কিছু নয়। একটি আঙুল অন্যের দিকে তোলা হলে চারটি আঙুল নিজের দিকে ইঙ্গিত করে। এটা অনেকটা সেই রকম।
এ বারের দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গে ফেরা যাক। করোনার কারণে এ বার পুজো বন্ধ থাকবে বলে পুলিশের নাম করে সমাজমাধ্যমে একটি প্রচার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বেশ কিছু দিন আগে। সেটি ছিল ভুয়ো। কিন্তু তারই জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কত বড় ‘হিন্দুবিদ্বেষী’, সে কথা ফলাও করে বলার পরিসর পেয়ে গিয়েছিল নির্দিষ্ট একটি মহল। তা নিয়ে চর্চাও বাড়ছিল ক্রমশ।
মহরমের দিন রাজ্যে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন কেন বন্ধ রাখা হবে, সেই প্রশ্নে এর আগে আইন-আদালত হয়েছে। প্রকাশ্যেই তা নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিজেপি। বছর দুয়েক আগে এক বার রটনা হয়, এই রাজ্যের কোনও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আর সরস্বতী পুজো করা যাবে না। সেই মিথ্যাও অচিরে ধরা পড়ে যায়।
এখন আবার করোনা-আবহে দুর্গাপুজোর অনুমোদন মমতা কেন দিলেন, সেই বিতর্ক মাথাচাড়া দিল। সুরক্ষা বিধি আরোপ করেও শারদোৎসবে সরকারি সিলমোহর দেওয়া কত দূর সঙ্গত হয়েছে, কেউ সেই প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও আদালত তার পর্যবেক্ষণে রাজ্যের মূল সুরক্ষা-নির্দেশিকায় কোনও অনাস্থা প্রকাশ করেনি। তবে পরিকাঠামোর বিভিন্ন অসুবিধার দিক বিবেচনা করে সুরক্ষা কার্যকর করার ক্ষেত্রে আরও কিছু নির্দেশ জারি হয়।
কিন্তু আইন-আদালতের বাইরে যে সব প্রশ্ন থাকে, তা রাজনীতির। দুর্গাপুজোয় উদ্যোগী হওয়ার জন্য এখন মমতার সমালোচনায় মুখর কোনও ‘হিন্দুত্ববাদী’ নেতা কি এক বারও দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এ বার সর্বজনীন পুজো বন্ধ থাক? যাঁরা পুজো বন্ধের ভুয়ো বার্তা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টায় নেমেছিলেন, ‘হিন্দুত্ব’-এর ধ্বজাধারী কোনও নেতা কি তার প্রতিবাদে যথার্থ ভাবে সরব হয়েছিলেন? যদি না হয়ে থাকেন, তা হলে কি তার পিছনেও কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের অঙ্ক ছিল?
সেই অঙ্ক যদি ভোটের হয়, তা হলে মমতা যা করেছেন তা-ও নিঃসন্দেহে ভোট-কেন্দ্রিক। তিনিও নিশ্চয় চাননি, তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বা ‘পুজো-বিরোধী’ অভিযোগ হাওয়া-বাতাস পাক। বিশেষত ভোটের মুখে এমন চর্চা কোনও রাজনীতিকই চাইবেন না। আমরা দেখেছি, বিজেপির রামনবমী পালনের ফাঁদে পড়তে হয়েছে তৃণমূলকে। সে ভাবেই করোনাকালে দুর্গাপুজো বন্ধ করার কোনও ‘রাজনৈতিক ঝুঁকি’ হয়তো ভোটের মুখে শাসক মমতা নিতে চাননি।
অনেকে বলছেন, ওনামের পরে কেরলে করোনার হাল দেখে পুজো নিয়ে বাংলা কঠোরতর হতে পারত। মহারাষ্ট্রে গণেশ-চতুর্থী বা গুজরাতে নবরাত্রি সমারোহ বন্ধ করার মতো দৃঢ় পদক্ষেপও নিশ্চয় প্রশংসনীয়। দিল্লি ও বিজেপি-শাসিত অন্য কিছু রাজ্যে দুর্গাপুজোও এ বার নিয়ন্ত্রিত।
সব ঠিক। কিন্তু লক্ষণীয়, তাদের কারও গায়ে ‘পুজো-বিরোধী’ বা ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ তকমা লাগানো হয়নি। দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যের রাজনীতি সেই সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে আজ। তাই পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তালি তো এক হাতে বাজে না।
আরও বড় পরিহাসের বিষয় হল, অভিনব নজির গড়ে রাজ্য বিজেপি নিজেই এখানে একটি সর্বজনীন পুজোর উদ্যোক্তা! সেখানে প্রতি দিন নামী শিল্পী এনে জলসার ঘোষণাও হয়েছে। কোনও কারণে সেই কর্মসূচির যদি রদবদলও হয়, সেটা কিন্তু হবে চাপে পড়ে। আদত বিষয়টি কি তাতে ঢাকা পড়ে?
তবু আবার বলব, পুলিশ-আইন-রাজনীতি সব কিছুর উপরে হল মানুষের শুভচেতনা। আমরা পুজো পরিক্রমায় বেরোব না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় এবং দায়িত্ব সাধারণ মানুষের। এ বারের দুর্গোৎসব হোক সেই সংযমের সাধনা। ‘বঞ্চিত’ করে বাঁচানোর আর্তি হোক অঞ্জলির মন্ত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy