ছবি: সংগৃহীত
কিছু দিন আগে আমাজনের জঙ্গলে আগুন লাগাকে কেন্দ্র করে সমস্ত পৃৃথিবী উত্তাল হয়েছে। কেঁদেছে প্রকৃৃৃতিপ্রেমী অগণিত মানুষ। শোনা যাচ্ছে সে আগুনের পিছনেও গভীর চক্রান্ত। প্রাকতিক দাবদাহ সেটি নয়। অরণ্যচারী মানুষের ব্যাকুল আর্তি সামাজিক মাধ্যম ভরিয়ে তুলেছে। প্রকৃৃৃতিকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাঁরা। আবার আমরা যদি চার দিকে (পড়ুন ভারতে) ঘটে চলা নারী নির্যাতনগুলি খেয়াল করি, তা হলেও সভ্যতার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এক হতাশাগ্রস্ত প্রশ্নচিহ্ন সামনে এসে পড়বে— ‘সভ্যতা কি ক্রমে অসভ্য হচ্ছে?’ রাজধানী দিল্লির বুকে ঘটা নির্ভয়া কাণ্ডের নৃশংসতায় আমরা আজও শিউরে উঠি। অথচ সেই চার অভিযুক্তের সাজার দিন পিছিয়েই যাচ্ছে। অবশ্য তাদের মত্যুদণ্ড দিলেই যে এ জাতীয় অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে, সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নন।
তবে মেয়েটির জন্য সঠিক বিচার হবে সেটি বলে অনেকে মনে করছেন। ‘ধর্ষণ’ আর ‘কর্ষণ’ শব্দ দু’টি যেন একই পরিবারের দুই সদস্য বলে মনে হয়। তবে প্রথমটির সঙ্গে জুড়ে আছে জোরজবরদস্তি আর দ্বিতীয়টির সঙ্গে স্বাভাবিকতার ধর্ম। একটির সঙ্গে চূড়ান্ত অসম্মান তো অপরটি সৃৃৃৃষ্টির পরম আনন্দ। প্রকৃৃৃৃতি ও নারীর সঙ্গে এই দু’টি বিষয়ই ভীষণ ভাবে সত্য।
ইতিউতি শুনতে পাই, কিছু কিছু পুং শাবক ধর্ষণ সম্পর্কে বলেন ‘ইটস্ আ পার্ট অফ গেম’। তাদের উদ্দেশে এক দলা ঘৃৃৃণা উগলে আসে। জানি না আমাদের বসুন্ধরার গর্ভে আর কত নারী নিধনকারী তথা প্রকতি বিনাশকারী রয়েছে! এমন কোনও ক্লিনিক যদি আবিষ্কৃৃৃৃত হত যেখানে এহেন পুং-ভ্রুণগুলিকে চিহ্নিত করে নিকেশ করা যেত!
নারীলাঞ্ছনার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা আদৌ নিছক যৌনতার বশে এ সব করে বলে মনে হয় না। এগুলি আসে বিকতকাম থেকে। যেটা পশুরও থাকে না। থাকে কিছু পুরুষের মতো দেখতে মানুষের। নারীর চূড়ান্ত অবমাননার পরে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে তাঁকে পুড়িয়ে (সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা) সমস্ত প্রমাণ লোপাটের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে কিছু ওই সম্প্রদায়ের দুর্বৃৃৃত্ত।
হ্যাঁ, এদের পুরুষ না বলে দুর্বৃৃৃৃত্ত বলতেই পছন্দ করি। কারণ ‘পুরুষ’ শব্দটি ইতিবাচক আমাদের সভ্যতায়। যা থেকে পৌরুষ শব্দের উৎপত্তি৷ পুরুষ নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করেন, তাঁকে অসম্মান করেন না৷ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে একটা নান্দনিকতা আছে, যা দিয়ে অনেক অমর কাহিনি লেখা হয়েছে। কিন্তু নারীনিধনের যে চক্রান্ত চলছে, তাতে যে হারে ওই দুর্বত্তেরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে কী ভাবে নব নব উপায়ে নারীদের অপমান করা যায়— তাতে আমরা শিউরে উঠছি। সৃৃৃৃষ্টির দেবতাও এ বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন না তো, ধ্বংসের অসুরের ভয়ে! আমরা আতঙ্কিত।
ইকো-ফেমিনিসজ় তত্ত্বটি আজ বড় বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। আসলে নারী ও প্রকৃতি উভয়েই সৃৃৃৃষ্টিশীল এবং অপরকে লালন করার সহজাত ক্ষমতার অধিকারী। প্রকৃৃৃৃতি বা নারীকে আক্রমণ বা আঘাত করলে তাঁরা প্রত্যাঘাত করতে পারে না। প্রকৃৃৃতি মানুষকে অনন্ত আঁচলখানি বিছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ প্রকৃৃৃৃতিকে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত করে চলেছে। মানুষের এই ধ্বংসাত্মক রূপ প্রকতিবিরোধী। যে প্রকৃৃৃৃতি মানুষকে মায়ের কোল দিয়েছে, নির্ভরতার আশ্রয় দিয়েছে সেই প্রকৃৃৃৃতিকেই মানুষ আঘাত করেছে বারে বারে। নিজেদের স্বার্থে জঙ্গল কেটে ফেলছে নির্দ্বিধায়। বনাঞ্চল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণীরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়ছে।
এর ফল কিন্তু হচ্ছে ভয়াবহ। প্রকৃৃৃৃতির প্রতিশোধ পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ প্রকৃৃৃৃতিপ্রদত্ত নির্মল বায়ুও দূষিত। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃৃৃতির ভারসাম্যও। কিছু ক্ষেত্রে অশিক্ষা আর কিছু ক্ষেত্রে মানুষের অনন্ত সুখভোগের আকাঙ্ক্ষাই এর জন্য দায়ী। বাড়ছে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। প্রকৃৃতির ধ্বংসলীলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যনতুন রোগভোগ।
নারীনিধন যজ্ঞে যে ভাবে মেতেছে আমাদের অসভ্যতাকামী সমাজ, তাতে আশঙ্কা জাগে এর প্রভাব তো পুরো সভ্যতাকেই চরম বিনষ্টির পথে নিয়ে যাবে। আসলে আমাদের একটা খেদ জেগেই থাকে সেটা হল আমরা একটা স্ববিরোধী সভ্যতার অংশীভূত। যেখানে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ বলে নারীশক্তির আরাধনা করা হয় সেখানেই আবার নারী ভ্রুণটিকে হত্যা করা হয়। পণের জন্য পুড়িয়ে মারা হয় বাড়ির বৌকে। রাস্তাঘাটে বেরনো রমণীদের কেউই বোধ হয় বলতে পারবেন না যে তাঁর সঙ্গে কোনওরকম অভব্যতা হয়নি। কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা সকলেরই আছে। অনেকেই নিদান দিচ্ছেন সঙ্গে চাকু রাখুন, লঙ্কার গুঁড়ো রাখুন; নিদেন পক্ষে সেফটিপিন। আরে বাবা, দুর্বৃৃৃত্তদের থাবা যে কখন এসে পড়বে তা কী করে বোঝা যাবে? শিকারীদের হাতে অসহায় ভাবেই শিকার হয়ে যেতে হয় যে।
মেয়েদের বাধ্যতামূলক ভাবে ক্যারাটে শিক্ষার কথাও বলছেন অনেকেই। কিন্তু নির্ভয়া তো ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ছিলেন। হল কী! হয়তো প্রাথমিক ভাবে নিজেকে রক্ষা সম্ভব। কিংবা ওই সকল আত্মরক্ষার সামগ্রী রাখলে কিছু ক্ষেত্রে বিপদ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু সবসময় নয়। বাস্তবটা অনেক সময়েই এতটাই আকস্মিক যে সে সময়টুকুও বিপদগ্রস্ত মেয়েরা পান না।
তাই মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ না দিয়ে বরং পুরুষদের প্রকৃৃৃৃত পুরুষ বা পুরুষোত্তম হয়ে ওঠার পাঠ দিন এই সমাজ। জন্মের পর থেকে পরিবারের পুত্র সন্তানকে নারীজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব গড়ে তুলতে পারলে সমাজেরই মঙ্গল। নারী মানেই পরিতৃৃৃপ্তির আধার নন, বরং সৃৃৃষ্টির উৎস নারী। যাঁর গর্ভেই জন্ম নিতে হয় সকল পুরুষকেও। কাজেই তাঁদের প্রতি শৈশব থেকেই শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গড়ে উঠলেই পুরুষের দ্বারা নারীর লাঞ্ছনার ধারাবাহিকতা বন্ধ হতে পারে।
হিংস্রতার উত্তর হিংস্রতা নয় বলে যে যতই গলা ফাটাক, আমরা কিন্তু বলব, সৃৃৃষ্টির উৎস নারীর অবমাননার শাস্তি অবশ্যই জোরালো হোক। বিচারব্যবস্থার যে গতিমন্থরতা তাতে দ্রুততা আসুক। আইন জোরালো হোক। বিশেষ আর্জি জানাই আমাদের আইনব্যবস্থাকে— দ্রুততর হোক নারীপীড়কের শাস্তি প্রক্রিয়া।
শ্রীপৎ সিং কলেজের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy