আমাদের ভূমির প্রাচীন শাস্ত্রগুলি এই বিদেহীদেরকে ‘ভূত বলে চিহ্নিত করেনি। ছবি: পিক্স্যাবে।
আজ, শুক্রবার ভূতচতুর্দশী। অতিলোকের দরজা নাকি এদিন কিছুক্ষণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। ‘ভূত’ বলতেই মাথায় আসে মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মার কথা। কিন্তু আমাদের ভূমির প্রাচীন শাস্ত্রগুলি এই বিদেহীদেরকে ‘ভূত বলে চিহ্নিত করেনি। পুরাণ বা তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে উঁকি দিলে এমনটা মনে হওয়ার কোনও অবকাশ ঘটে না। ‘ভূতডামরতন্ত্র’-এ এমন কিছু সত্তার বর্ণনা রয়েছে, যাদের ‘ভূত’ বলে বর্ণনা করা হলেও তারা মানুষের বিদেহী আত্মা নয়। তারা অন্য কোনও লোকের বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যে এমন জগতের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন কেউ কেউ। ভূতচতুর্দশীতে ‘ভূত-সন্ধান’ তাঁদের কয়েকটি রচনা নিয়েই।
১.
এক সাইকিক সোসাইটিতে নিয়মিত বসে প্ল্যানচেটের আসর। মিডিয়াম রেখা চক্রবর্তী নামে ১৭-১৮ বছরের একটি মেয়ে। তাকে আশ্রয় করেই নামে পরলোকগত আত্মারা। কিন্তু সম্প্রতি মেয়েটি চক্রে বসতে ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনও দুষ্টশক্তি তার মাধ্যমে প্রবেশ করতে চাইছে জীবন্ত মানুষের জগতে। এমনই একদিন চক্রে পর পর দু’টি বিদেহী আত্মা এসে সাবধান করে দিয়ে গেল আসরের লোকদের, রেখাকে সেদিনটা যেন রেহাই দেওয়া হয়। কারণ, কোনও অপ্রাকৃত অপশক্তি তাকে আশ্রয় করতে চাইছে। কিন্তু সেদিন আবার এক দর্শনের অধ্যাপকের অবিশ্বাস ভঞ্জনের জন্যই সিয়াঁস বসানো হয়েছে। আসরের হোতারা সাবধানবাণী গ্রাহ্য না করেই সিয়াঁস চালিয়ে যেতে থাকলেন। হঠাৎ ঘরের সকলে অনুভব করলেন, অস্বাভাবিক ঠান্ডা লাগছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। রেখার গলা থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। ঘরের আলো জ্বালাতে দেখা গেল, দেওয়ালে এক বিরাট ছায়া, যার চেহারা অনেকটা মানুষের গায়ের কোনও চর্মরোগের মতো, বাঁশের গায়ে বর্ষায় গজানো ছত্রাকের মতো। সেই ছায়া যেন ক্রমে গ্রাস করছে সেই ঘরকে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা। এক সময়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল ঘরের সবাই। জ্ঞান ফিরতে দেখা গেল, রেখা এলিয়ে পড়ে রয়েছে আর সেই অধ্যাপক ভদ্রলোক মৃত। সিয়াঁস তো তাঁরা প্রায়ই করেন, আত্মাও প্রতি বারই আসে, কিন্তু এবার এমন কেন হল? পরে জানা গিয়েছিল, সেদিন সেই প্রেতচক্রে যার আবির্ভাব ঘটেছিল, সে কোনও বিদেহী আত্মা নয়। সে অন্য ভুবনের কোনও হিংস্র প্রাণী। চক্রে উপস্থিত সকলের শরীর থেকে স্থূল উপাদান সংগ্রহ করে সেই প্রাণী নিজে এই জগতের উপযুক্ত দেহ ধারণ করতে চাইছিল। সে সমর্থ হলে কী ঘটত, তা তাঁর ‘খোলা দরজার ইতিহাস’ গল্পে জানাননি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘ভূতডামরতন্ত্র’-এ এমন কিছু সত্তার বর্ণনা রয়েছে, যাদের ভূত বলে বর্ণনা করা হলেও তারা মানুষের বিদেহী আত্মা নয়। তারা অন্য কোনও লোকের বাসিন্দা। ছবি: পিক্স্যাবে।
মৃত্যুর পরে কেন পরিচিত মানুষও ‘ভয়াল’ হয়ে উঠবে, প্রেতচর্চাকারীরা সেই যুক্তি মানেন না। তাই বিদেহী আত্মাকে তাঁরা ভয় পান না। কিন্তু চেনা-আধোচেনা জগতের বাইরের যদি কিছু হঠাৎই সামনে চলে আসে? পশ্চিমের অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের যুগপুরুষ এইচ পি লাভক্র্যাফট তাঁর ‘সুপারন্যাচারাল হরর ইন লিটারেচার’ নামক সন্দর্ভ শুরুই করেছিলেন একথা দিয়ে— মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী অনুভূতি হল ভয়। এবং ভয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী হল অজ্ঞাত বিষয়-জনিত ভয়। বিদেহী আত্মা সেই অর্থে ‘অজ্ঞাত’ নয়। কিন্তু জানা জগতের বাইরে অবস্থানরত অজ্ঞাতরা যদি হঠাৎই চলে আসে সামনে?
আরও পড়ুন: বাজি থেকে বাঁচতেও আদালত
২.
যে ভয় জ্ঞাত জগতের একেবারে বাইরে, তার কথা বিভূতিভূষণ লিখে গিয়েছেন তাঁর বেশ কিছু গল্পে। বাংলার গ্রামজীবনে ছড়িয়ে থাকা অমঙ্গল ভাবনাকে, মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ছায়ালোককে তিনি লিখে গিয়েছেন অসীম যত্নে। সেই যত্নকে প্রলম্বিত দেখা যায় সমকালীন আরেক লেখক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের রচনায়। ‘চাওয়া ও পাওয়া’ নামে এক গল্পে তিনি এক নাছোড়বান্দা ঈশ্বর-অন্বেষীর কথা লিখেছিলেন, যিনি এক তান্ত্রিকের কাছে প্রায় হত্যে দিয়ে পড়েন দেবদর্শনের জন্য। শেষ পর্যন্ত তান্ত্রিকের দৌলতে দেবতার বদলে যা দৃশ্যমান হয়, তা নিদারুণ বিভীষিকা। সেই দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনে নেমে আসে ঘোর অমঙ্গল। তাঁর আর একটি কাহিনি ‘পিশাচ-সিদ্ধ’। এক মহাপণ্ডিত শাস্ত্রবিদের পিশাচসিদ্ধ হতে গিয়ে আত্মধ্বংসের করুণ কাহিনি। অপশক্তিকে তুষ্ট বা বশ করে কার্যসিদ্ধির সাধনের পরম্পরা তন্ত্রমার্গের ছায়াচ্ছন্ন অলিগলিতে বিদ্যমান।
যে ভয় জ্ঞাত জগতের একেবারে বাইরে, তার কথা বিভূতিভূষণ লিখে গিয়েছেন তাঁর বেশ কিছু গল্পে। ছবি: পিক্স্যাবে।
গজেন্দ্রকুমারের কলমে এই দেশজ অমঙ্গলের জগৎ ভয়াবহ আকৃতিতে এসেছে ‘নজর’ নামের একটি গল্পে। কাহিনিটি পূর্ববঙ্গের এক গ্রামীণ গৃহস্থ পরিবারের। এক বধূ তার শিশুসন্তানকে সন্ধেবেলায় উঠোনের এমন এক জায়গায় বসে দুধ খাওয়াচ্ছিল, যাকে চলাচলের পথ বলা যায়। গ্রামীণ বিশ্বাস অনুযায়ী, ওই রকম জায়গায় শিশুকে খাওয়ালে নাকি ‘অন্য দেবতাদের’ নজর লাগে। বিষয়টিতে তেমন গা করেনি বধূটি। কিন্তু কোথাও কিছু একটা ঘটে যায় অলক্ষ্যে। শিশুটির বয়স এক বছর পুর্ণ হওয়ার আগেই তাকে এক অচেনা মহিলা এসে কোলে নিয়ে আদর করে যায়। সেই সন্ধ্যা থেকে শিশুটি জ্বরে পড়ে এবং পরদিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই সে মারা যায়। এর পরেও যখনই ওই বধূটির সন্তান হয়, বছর ঘুরতেই না ঘুরতেই সেই সন্তান মারা যায়। প্রতি বারই সেই শিশুকে কোনও অপরিচিতা মহিলা আদর করার পরেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে তিন-তিনটি সন্তান বিয়োগের পর বোঝা যায়, কোনও অশুভ শক্তি এর পিছনে কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে আগমন ঘটে এক তান্ত্রিকের, তিনি বিষয়টির আশ্চর্য সমাধানের রাস্তা বাতলে যান। এর পর আবার সন্তান হয় বধূটির। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার আগেই ঘটে ক্লাইম্যাক্স। সেই চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছে গল্পকার যে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন, সে প্রেত নয়। তাকে শরীরী বা অশরীরী— কোনও শ্রেণিতেই ফেলা যায় না। সে চিরন্তন অশুভ। আমাদের মনোগহীনে লুকিয়ে থাকা ভয়ের মূর্তরূপ।
আরও পড়ুন: কালী-কথা: দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির
৩.
এই মূর্ত অশুভের পাশাপাশি আর এক অস্তিত্বের কথা অনেকে মনে করেন— ‘নিয়তি’। বাংলা সাহিত্যের ‘নীরব’ লেখক জগদীশ গুপ্তের ‘দিবসের শেষে’ বা ‘হাড়’ পড়লে বোঝা যায়, কেবলমাত্র ঘটনাচক্র কী ভাবে অঘটনকে সম্ভব করে তোলে, সেই ধরনের কাহিনি নির্মাণে তাঁর দক্ষতা ছিল। ‘অ-মৃত’ নামে তাঁর এক গল্পে গ্রামের এক বাড়িতে আগমন ঘটে এক মহিলা এবং তাঁর ছেলের। বহুদূর থেকে তাঁরা এসেছেন। মহিলার দাবি, তাঁর অকালমৃত শিশুসন্তান পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই বাড়িতেই এসেছে। সত্যিই সেই বাড়ির এক মেয়ে তখন সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে আঁতুড়ঘরে। মহিলা জানান, তিনি স্বপ্নে জানতে পেরেছেন সেই সদ্যোজাতই তাঁর অকালপ্রয়াত ছেলে। এমনকি, তিনি এক অভিজ্ঞান চিহ্নের কথাও বলেন, যা ওই সদ্যোজাতের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হন সেই ঘটনা। তাঁরা মহিলাকে অনুরোধ করেন শিশুটিকে দেখতে। মহিলা জানান, তিনি দেখতে আসেননি, শুধু খোঁজ নিতে এসেছিলেন তাঁর স্বপ্ন সত্য কি না। তাঁর মৃত ছেলে আবার ফিরে এসেছে, মায়ের কোল পেয়েছে, এতেই তিনি তুষ্ট। পরে কখনও তিনি আসবেন।
‘নজর’ যদি এক অজানা অশুভের কথা বলে থাকে, ‘অ-মৃত’ বলেছে আরেক অতিপ্রাকৃতের কথা। তার নাম নিয়তি। সে যেমন বিপর্যয় নিয়ে আসে, তেমনই সে শুভেরও ইঙ্গিত দেয়। সে শুভাশুভের অতীত আরেক ছায়াসত্তা। সাহিত্য মনের দর্পণ হয়ে থাকলে এই অতিলোক রয়েছে আমাদের মনের ভিতর। চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকারকে দূর করার এই উৎসবের দিনে সেই আধো চেনা আলো-আঁধারির জগতের কথা অবধারিত ভাবে মনে আসে। যেখানে অশুভের সঙ্গে স্থান করে নেয় চির-অজ্ঞেয় নিয়তিও। সে-ও যেন এই লোকেরই আরেক বাসিন্দা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy