পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত উত্তর অঞ্চলে বসবাসকারী রাজবংশী বলে পরিচিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকজীবন ও সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রথম তুলে ধরেন চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর দ্য রাজবংশীজ অব নর্থ বেঙ্গল বইয়ে (১৯৬৫)। অর্ধশতক পেরিয়ে তারই অনুবাদ করেছেন তৃপ্তি সান্ত্রা (উত্তরবঙ্গের রাজবংশী, আনন্দ, ৫০০.০০)। রাজবংশীদের জনবিন্যাস, পার্থিব সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বিবাহরীতি, মৃত্যু ও সংশ্লিষ্ট আচার, সংগীত, উপভাষা ইত্যাদির যে গভীর ও বিস্তারিত আলোচনা দীর্ঘ ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে করেছিলেন চারুচন্দ্র, তা নতুন প্রজন্মের কাছেও নিঃসন্দেহে সমান মূল্যবান আকরসূত্র।
লেখক জানিয়েছেন, চড়ক বা নীলপুজোর সন্ন্যাসীদের বলা হয় বালা। তা থেকেই বালাই ষাট শব্দবন্ধ। দেশভাগ নিয়ে স্মৃতিকথার এই আখ্যান (শিকড়ছেঁড়া জীবন, যতীন বালা, গাঙচিল, ৪৫০.০০) এক রাতের অন্ধকারে শুরু। বালকের চোখের সামনে তখন গ্রাম পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। হিন্দুপ্রধান গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মুসলমানেরা। স্মৃতি যত পরত খোলে, ততই চমক! মা সূতিকাজ্বরে অসুস্থ, ফলে তাঁর মুসলমান সই ফতেমা নিজের স্তন্যপান করিয়ে যান হিন্দু শিশুকে। অন্য দিকে, বৃষ্টিতে নমঃশূদ্র পিতা তাঁর শিশুসন্তানকে নিয়ে ভট্টাচার্য বাড়ির গাছতলায় ক্ষণিক আশ্রয় নিলেও ব্রাহ্মণ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘যা ভাগ! কোন আক্কেলে বামুনের বাড়ি ঢুকলি!’
‘আজকাল কেন জানি না আগেকার কত স্মৃতি মনে পড়ে। কোথায় গেল বাগানের সিঁড়িতে বসে বইপড়ার সাক্ষী সেই সাদা ফুলে-ভরা মেঘটগর গাছ?... কে বোঝে আমার বেদনা? কবিতায় কতটুকু বলতে পেরেছি?’ ঈর্ষণীয় তাঁর গদ্যশৈলী, অথচ গদ্য অল্পই লিখেছেন, আদ্যন্ত কবি হিসেবেই সকলে জানেন দেবারতি মিত্রকে। নিজের জীবন, কবিতা ও কবিদের নিয়ে লেখা তাঁর এই গদ্যসংগ্রহ (অবভাস, ২৫০.০০) আদতে তাঁর কবিমনের গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছনোর এক গদ্যপ্রয়াস যেন।
‘অনেকেই মনে করে নিয়েছি, কলকাতার রকবাজদের ভাষা বসিয়ে গেলেই তা বাংলা গদ্য হয় কিংবা প্রত্যহ খবরের কাগজ পড়লে এবং/ অথবা সম্পাদকীয়/ কলম ইত্যাদি লিখলে বাংলা গদ্যে পারদর্শিতা জন্মে।’ উপন্যাসের ভাষা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ-নিবন্ধটিতে আরও তির্যক মন্তব্য অমিয়ভূষণ মজুমদারের: ‘থিমকে হতে দেয়া আর থিমকে বর্ণনা করা এক বিষয় নয়। এবং এটা হয় গদ্যের অযোগ্যতায়।’ উপন্যাসের শিল্পরীতি আর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রয়োজনীয় গদ্যাদি তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ-এ (দে’জ, ৪০০.০০)।
অলোক রায়ের নিপুণ ও প্রাজ্ঞ সম্পাদনায় প্রকাশ পেল উত্তরসূরি/ নির্বাচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ (সূত্রধর, ৬৫০.০০)। প্রথম দুটি পর্বে স্বল্পস্থায়ী হলেও তৃতীয় পর্বে অরুণ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১৯৫৪ থেকে প্রায় তিরিশ বছর নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে এই ত্রৈমাসিক পত্রটি। বাংলা সাহিত্যপত্রের ইতিহাসে এ-পত্র স্থায়ী ভাবে রক্ষণীয় বলেই এ-উদ্যোগ। সাহিত্য তো বটেই, সংগীত চিত্রকলা শিল্প সমাজ— বিবিধ বিষয়ের প্রবন্ধে ঋদ্ধ সংগ্রহটি। বাংলা মননসাহিত্যের দুর্বলতা ও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের না-লেখা ইতিহাসের কথা খেয়াল রেখেই এ-সংকলন ‘প্রকাশ জরুরি বোধ করছি।’ জানিয়েছেন অলোকবাবু।
প্রয়াত রবিশংকর বল ও লেখক-পুত্র কুশলের সম্পাদনায় সুবৃহৎ দুই খণ্ডে বেরল অসীম রায়ের (১৯২৭-৮৬) আত্মজীবনী জীবন-মৃত্যু (৯ঋকাল বুকস, প্রতি খণ্ড ৬০০.০০)। এই আশ্চর্য মায়ামুকুরে উঠে এসেছে স্বাধীনতা-পূর্ব অখণ্ড বাংলা থেকে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত পশ্চিমবঙ্গের চালচিত্র। তাতে শুধু দেশ-কাল-সময়-সমাজ-সংস্কৃতিকেই নয়, নিজেকেও যুক্তি ও স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন লেখক। তাঁর আত্মকথনে উঠে এসেছেন বহু বিশিষ্ট জন। পঁচিশ বছরের সঙ্গিনী গীতার আকস্মিক মৃত্যুতে ‘যে শূন্যতা নামে জীবনে তার সামনে দাঁড়াবার জন্য আশ্রয়’ খুঁজতেই এ আত্মজীবনীর শুরু, জানিয়েছেন লেখক।
বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা বিদেশীয়দের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। দেশীয় পণ্ডিতগণ কিন্তু জাতীয়তাবোধ থেকেই লোকায়ত সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হন। নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতি আন্তরিক টানেই লোকসংস্কৃতির অনুশীলনের প্রসারে তাঁদের কৃতিত্ব মনে রাখার মতো। প্রথম যুগের বাংলা লোকসাহিত্য চর্চায়/বাঙালির অবদান (সহজপাঠ, ২০০.০০) শীর্ষক বইটির ভূমিকায় লেখক মনোজ মণ্ডল জানিয়েছেন, ‘বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার প্রথম যুগে বিদেশীয়দের অবদানসহ এ দেশীয়দের লোকসংস্কৃতির চর্চার কৃতিত্বের দিকটি তুলে ধরাই বর্তমান গ্রন্থের মূল অভিপ্রায়।’
কারা ছিলেন বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের পত্তনের শুরুতে, কিংবা দেশব্যাপী প্রশিক্ষিত গ্রন্থাগারিক তৈরিতে কোন মানুষেরা অবদান রেখে গেলেন নীরবে? অসিতাভ দাশ ও প্রদোষকুমার বাগ্চী রচিত গ্রন্থাগারিক চরিতাভিধান (সাহিত্যলোক, ৪৫০.০০) বইয়ে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার জগতের কেন্দ্র ও পরিধিতে উঠে আসা অসংখ্য মানুষের পরিচয় পেয়ে যাবেন পাঠক। প্রতিটি মহাদেশের সুপরিচিত গ্রন্থাগারিক ও গ্রন্থাগার সংগঠকের নাম তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা রয়েছে। ভারতসহ বাংলার গ্রন্থাগার আন্দোলনের বরণীয় ব্যক্তিবর্গের নামও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।
সম্পর্কের ত্রিকোণ/ রবীন্দ্রনাথ: সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল, গান্ধী (সিগনেট প্রেস, ২৫০.০০) গ্রন্থকার সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে দু’জনের পথ ১৯২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন, জুলাই মাসে কিছুদিনের জন্য সমুদ্রপথে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা এবং তারপরে অগস্ট থেকে দু’জনের পথ পরস্পরের বিরোধী। ঠিক কথা, যে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে আমি কোনও দৃষ্টি-বা-স্পর্শ-গ্রাহ্য প্রমাণ কি সাক্ষ্য পেশ করতে পারব না, কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবে চব্বিশ বছরের তরুণ সুভাষচন্দ্রের রবীন্দ্র-বিরোধী মানসিকতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।’ বইটিতে এ রকমই রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রে, তাঁকে ঘিরে গাঁধীজি, জওহরলাল এবং সুভাষচন্দ্র বসু— তিন সম্পর্কের কাহিনি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই সম্মিলিত তথ্যপুঞ্জে সমৃদ্ধ।
সংস্কৃতির মূল আঙিনায় নিয়মিত ঘোরাফেরা ছিল না অমিয়ভূষণ মজুমদারের। যেন এক নিঃসঙ্গ অরণ্যচারী নিজের পথ নিজেই করে নিয়েছেন চিরকাল। অমিয়ভূষণের কনিষ্ঠা কন্যা এণাক্ষী সেই অভিজাত নির্লিপ্ত পথিকের সন্ধান করে ফিরেছেন তাঁর বনেচর বইয়ে (দে’জ, ৫৫০.০০)। ‘বনে চরতীতি বনেচরঃ’। অরণ্যচারী, কিরাত। এণাক্ষী লিখেছেন, তাঁর বাবা একবার এক প্রবন্ধে এই অচলিত শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ৪৪০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy