মহামারি, অতিমারির ভিতর দিয়ে যাওয়ার ‘দুর্ভাগ্য’ মানবসভ্যতায় মোটামুটি একশো বছরে এক বার আসে। ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্লেগের ইউরোপ-আগমন থেকে আজ পর্যন্ত ধরলে এ রকম একটা ব্যবধান পাওয়া যায়। আরও পিছোতে থাকলে এই ফারাক একশো বছরে আটকে থাকবে না। ভারতের বেলায় ‘দুর্ভাগ্য’ আরও নির্মম। একই মহামারির মধ্যে এসেছে অন্য মহামারি। প্লেগের সঙ্গে কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত। এদের পিছনে মন্বন্তর। অগণিত জীবন নষ্ট হয়েছে, লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে যাবতীয় সম্পর্ক, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব। সমাজের চেহারা হয়েছে হিংস্র। বিপন্ন, বিধ্বস্ত মানুষ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এতই মত্ত হয়ে পড়েছে যে, নিকটজনের দিকে ফিরে তাকানোরও ফুরসত হয়নি তার। এটাই মহামারির আসল ভয়াবহতা। সে যখন প্রলয়নাচন শুরু করে, প্রাণের সঙ্গে মনকেও ধ্বংস করে।
আমরা সেই ‘দুর্ভাগা একশো বছর’-এ পৌঁছেছি, এবং পেয়েছি অতিমারি কোভিড-১৯। কিছু দিন আগে পর্যন্ত যা ছিল বইয়ের পাতায় ও সিনেমার পর্দায়, তা নেমে এসে দঁাড়িয়েছে মুখোমুখি। প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু এবং সেই সঙ্গে এ দেশে গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, কলেরার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। মাথার উপর বিদেশি শাসক নেই, বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা পেরিয়েছে দীর্ঘ পথ। তার পরও আমরা কী দেখলাম? দেখলাম, অতিমারি তার নির্মম চরিত্রটি বদলায়নি। করোনা আক্রান্তকে বাড়ি ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না, চিকিৎসককে পাড়াছাড়া করা হচ্ছে, মুমূর্ষুকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আক্রান্তকে তো বটেই, তার পরিবারকেও একঘরে করা হচ্ছে, ফুটপাতে পড়ে থাকা রোগীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। সেই সঙ্গে গুজব, আতঙ্ক, কুসংস্কার। একশো বছর আগের মতো মুখে মুখে নয়, তারা উড়ছে উন্নত টেকনোলজির ডানায় ভর করে। ফলে গতি আরও দ্রুত, তীব্রতা আরও মারাত্মক। আমাদের বিজ্ঞান ও সভ্যতার অহঙ্কারে টোকা দিয়ে অতিমারি মুচকি হাসছে।
কিন্তু এই কি সব? না, তা নয়। এক দল যখন মহামারির কাছে হঁাটু মুড়ে বশ্যতা স্বীকার করে, মনুষ্যত্বকে জমা রাখে তার পায়ের কাছে, ভাবে এতেই রোগ সারবে, ফিরবে স্বস্তি, আর এক দল তখন মহামারিকে রুখতে কোমর বাঁধে। কখনও ব্যক্তিগত ভাবে, কখনও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে চলে এই লড়াই। আর তৈরি হয় দুঃসময়ের উজ্জ্বল দিনলিপি।
দুঃসময়ের দিনলিপি
শংকর
৩০০.০০
দে’জ পাবলিশিং
এমনই এক ‘দিনলিপি’ লিখেছেন শংকর। অতীতে আমাদের দেশে মহামারি, অতিমারি, মন্বন্তরে সেবা-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্প দিয়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসকে যাঁরা মহিমান্বিত করেছেন, এই ‘দিনলিপি’ তাঁদের নিয়ে।
বইটি আসলে ‘দুঃসময়ের আলো’। যে আলো তৈরি করেছেন সেবাব্রতী সন্ন্যাসী, সেবিকা, নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, দূরদর্শী গবেষক এবং শিল্প-সাহিত্যের সাধকেরা। এই দিনলিপি বর্তমান দুঃসময়ে দঁাড়িয়ে অতীতের দুঃসময়ের দিকে ফিরে তাকানো। রোগ, কষ্ট, হতাশাকে জয় করার যে লড়াই বাংলায় হয়েছিল, তাকে আরও এক বার দেখা। দেখা? না কি মনে করিয়ে দেওয়া আমাদের গরিমার কথা?
অবশ্যই এই লড়াইয়ের অগ্রপথিক স্বামী বিবেকানন্দ, সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা আর রামকৃষ্ণ মিশনের বিশ্ববন্দিত সন্ন্যাসীরা। মহামারি, অতিমারি, মন্বন্তরে এই মহামানবদের সেবাকর্ম চিরভাস্বর। কলকাতার প্লেগ অতিমারিতেও যার অন্যথা হয়নি। স্বামীজি প্লেগ জর্জরিত শহরের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে, মিশনের প্রিয় শিষ্যদের। অতি প্রাসঙ্গিক ভাবেই এই বইয়ে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, মঠের সন্ন্যাসীদের সেবাকর্মের ইতিবৃত্ত রয়েছে সিংহ ভাগ জুড়ে। বই, চিঠিপত্র, সংবাদপত্র থেকে পাওয়া অজস্র তথ্য ও ঘটনা উল্লেখ করেছেন লেখক, এই উৎকণ্ঠায় যা মনকে উজ্জীবিত করে। এক দিকে প্রচার, আবেদন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ, অন্য দিকে হাতেকলমে প্লেগের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঝঁাপিয়ে পড়া। সাহসিনী ভগিনী নিবেদিতা হাতে ঝঁাটা নিয়ে পথ পরিষ্কারে নেমেছিলেন। সন্ন্যাসী সদানন্দ শহরের অলিতে-গলিতে ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে সরিয়েছিলেন জঞ্জাল। দুর্গতদের সেবায় আত্মদান করেছিলেন স্বামী অখণ্ডানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে এই তিন সেবাব্রতীকে নিয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বইয়ে। তাঁদের ভাষণ, আবেদন, বিজ্ঞানের প্রতি অবিচল বিশ্বাস যেমন বাংলার যুবশক্তিকে অতিমারির বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ানোর শক্তি জোগিয়েছিল, পথে নেমে মুমূর্ষুর পাশে দঁাড়ানোর দৃষ্টান্ত অসহায় মানুষকে শক্তি দিয়েছিল।
সন্ন্যাসীদের সেবাকর্মে লেখক আলো ফেলেছেন, আবার খোঁজ নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথেরও। প্লেগে কী ভূমিকা ছিল তাঁর, কী ভাবে কলকাতায় প্লেগ ছড়ানোর খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে ছুটে এসেছিলেন তিনি, প্লেগ প্রতিরোধের নামে ইংরেজের অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
আলো পড়েছে বাংলার বিজ্ঞানসাধকদের কাজেও। বইটি বহুমুখী হয়ে উঠেছে। মহামারি, মন্বন্তরে বিধ্বস্ত বাংলার জন্য বিজ্ঞানীরা কী করেছিলেন, তার বিবরণ এসেছে অতি যত্নে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তঁার বিবিধ রচনায় মহামারি সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য জানিয়েছিলেন, রোগের লক্ষণ থেকে প্রতিষেধক পর্যন্ত। লিখেছিলেন চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর গবেষণার কথা। টিকা বিষয়ক তঁার রচনাগুলিও আজ শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, মনকে উন্মুক্ত করার মতো।
নানা গ্রন্থে, তথ্যে, অভিজ্ঞতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসকে একত্রে বেঁধেছেন শংকর। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ এবং মিশনের সন্ন্যাসীদের সেবাধর্মের বিষয়ে বিশেষ প্রাজ্ঞ, গুণী বাঙালির ইতিহাসচর্চায় অভিজ্ঞ, পুরাণ ও সাহিত্য পাঠে দীর্ঘ পথ পেরিয়েছেন। ফলে এই কাজে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তিনি মানবধর্মের সেবার দিকটিকে আলোকিত করেছেন। রেখেছেন অজস্র বইয়ের উদ্ধৃতি, চিঠিপত্র, তথ্য। অজানা সংবাদের মতো তা পাঠককে বিস্মিত করেছে। সঙ্গে তঁার স্বাদু গদ্য। যে গদ্য তথ্যকে ভারাক্রান্ত হতে দেয় না। যে গদ্য রসসিক্ত, আবার বেদনার্ত হয়ে মানুষের দুর্দশার কথাও বলে।
অতিমারির এই দুর্দিনে বইটি পড়ার শেষে বাঙালি হিসেবে গর্ব হয় বইকি। তবে কিছু অংশে বইটির আয়তন হয়তো আর একটু কম হতে পারত। বিদগ্ধ লেখক নিজেও তা কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। তাই যখনই প্রসঙ্গ থেকে সরেছেন, ফিরে এসেছেন দ্রুত।
বইয়ের আরও দু’টি অংশ উল্লেখ করতেই হবে। একটি, তথ্যসূত্র হিসেবে প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা। ভবিষ্যতে বিস্তারিত পাঠে উৎসাহী পাঠককে এই তালিকা সাহায্য করবে। লেখক যেন হাতের কাছে সাজিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি, বহু গুণী বাঙালির দুষ্প্রাপ্য ছবি। পরিপাটি মুদ্রণ, ভ্রম চোখে না পড়ার মতোই। অতিমারির সময়ে বইটি প্রকাশ পাঠকদের সমৃদ্ধ করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy