ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ
অর্ক দেব, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও সিরিল স্যাম
১৬০.০০
গুরুচণ্ডা৯
সমাজমাধ্যম তার নাম। কিন্তু, গোটা সমাজব্যবস্থাকে, এত দিন টিকে থাকা সামাজিক সাম্যাবস্থাগুলোকে ভিতর থেকে ভেঙে দিতে তার যে জুড়ি নেই, গত কয়েক বছরে সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গোটা দুনিয়া। কিন্তু, রাজনীতি ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করে সমাজমাধ্যমের এই বিধ্বংসী শক্তিকে? ফেসবুক কী ভাবে সাম্প্রদায়িক অশান্তি বাধায়, কী ভাবে খুঁচিয়ে তোলে যাবতীয় বিরোধ? অর্ক দেব, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা আর সিরিল স্যাম মূলত ভারতের প্রেক্ষিতে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। সেই উত্তর ভয়াবহ।
গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বড় মাপের সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটা— হাওড়ার ধুলাগড়ে, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে, হুগলির তেলিনিপাড়ায়। বইয়ের লেখকরা জানাচ্ছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা দেখেছেন যে, সেই হিংসার একেবারে মূলে রয়েছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ। “ধূলাগড়ে দাঙ্গা আটকাতে র্যাফ নেমেছিল। কিন্তু ২৫ কিলোমিটার দূরের কলকাতা শহর বা ধূলাগড় সংলগ্ন অন্যান্য জনপদে ফেসবুক হয়ে ‘খবর’, ছবি ছড়িয়ে বলা হচ্ছিল মুসলমানরা এলাকার দখল নিয়েছে। হিন্দু দোকানপাট ভাঙচুর করা হচ্ছে।... সত্যাসত্য যাচাই করার কোনো পথ খোলা ছিল না, সুপরিকল্পিত ভাবেই উদাসীনতাকে হাতিয়ার করেছিল মৌলবাদীরা।” বসিরহাটেও একই ঘটনা ঘটেছিল। “আরএসএস প্রচারক, হরিয়ানা বিজেপির রাজ্যকমিটির সদ্য (বিজেতা) মালিক একটি ভিডিয়ো শেয়ার করেন ফেসবুকে। সেখানে বেশ কয়েকজন মহিলাকে রাস্তার ওপর লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল। তিনি দাবি করেন, বাদুড়িয়ায় হিন্দু মহিলাদের ওপর এই অত্যাচার চলছে। পরে দেখা যায় অওরত খিলোনা নেহি নামক ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য ওটি।” অনেকেই সত্যি ভেবে নিয়েছিলেন এই মেসেজগুলো। বিশ্বাস করেছিলেন, সত্যিই বুঝি ঘটছে এই সব ঘটনা। তাতে যে হিংসার পালে বাতাস লাগবে, বিলক্ষণ জানতেন এই সব মেসেজের সওদাগররা। দাঙ্গা লাগলে যাদের রাজনৈতিক লাভ হয়, তারা সমাজকে টুকরো টুকরো করে ভাঙতেই চায়।
পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে দিল্লিতে গত বছরের অশান্তির ঘটনাক্রম দেখলেও একই ছবি পাওয়া যাবে, তথ্যপ্রমাণ-সহ দেখিয়েছেন লেখকরা। প্রতিটি ঘটনার পিছনেই নির্ভুল চিহ্ন বিজেপির। কেন, সেই কারণটা বোঝা সহজ। সমাজমাধ্যমের শক্তি কতখানি, ভারতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঢের আগে তা বুঝেছিল বিজেপি। তৈরি করেছিল এক বিরাট আইটি সেল। এখন ভারতীয় সমাজের গতিপ্রবাহ নির্ধারিত হয় সেই আইটি সেলের অঙ্গুলিহেলনেই। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন লেখকরা। অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা, সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহকে চড় মারছেন, এমন একটা ভুয়ো ছবি ছড়িয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, চাইলে যে কোনও ছবিকে, বা খবরকে, মুহূর্তে ভাইরাল করে দিতে পারেন তাঁরা, তাঁদের আইটি সেল এতটাই শক্তিশালী।
ঠিকই। সেই শক্তি তাঁদের আছে। এবং, ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিপদও এই শক্তিই। প্রতি দিন অজস্র মানুষের ফোনে, কম্পিউটারে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিষ। বিদ্বেষের বিষ। আর, আমরাও সেই মিথ্যেতেই বিশ্বাস করে জড়িয়ে যাচ্ছি ঘৃণার পাকে। কী ভাবে সমাজমাধ্যম প্রতিনিয়ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক বিদ্বেষের বাহন, ঘৃণার হাতিয়ার, না বুঝেই তাকে ব্যবহার করে চলেছি আমরা। বস্তুত, ব্যবহৃত হয়ে চলেছি। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে যে ঘৃণার বীজ পুঁতে দিচ্ছেন আইটি সেলের মাইনে করা কর্মীরা, আমরা বিনা প্রশ্নে, ও বিনা পারিশ্রমিকেই তাকে জল-সার দিয়ে বাঁচিয়ে চলেছি শেয়ার করে। এই ঘৃণার খেলায় আমরা খেলোয়াড়ও বটে, খেলনাও বটে। এবং, নিজেদের অজান্তেই। আমাদের চিন্তাকেও এখন নিয়ন্ত্রণ করে সমাজমাধ্যম।
এই বিদ্বেষের বাস্তুতন্ত্রের পুরো ছবিটা তুলে ধরার জন্য লেখকরা ধন্যবাদার্হ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy