উদারনৈতিক: জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে মহত্মা গান্ধী।
কিছু দিন আগেই যোগেন্দ্র যাদব এক বক্তৃতায় বলছিলেন, আজকাল আমরা নিজেরাই নিজেদের লেফ্ট-লিবারাল বলে পরিচয় দিই, যে ভাবে হিন্দুত্ববাদীরা বলে থাকেন— অথচ লেফ্ট আর লিবারাল যে এক হতে পারে না, এদের পরস্পরের বিরুদ্ধ হওয়াই দস্তুর, ভুলে যাই। ঠিকই, বাম আদর্শ বলতে কমিউনিজ়ম থেকে সোশ্যালিজ়ম যা-ই বোঝানো হোক না কেন, সবেরই গোড়ায় লিবারালিজ়ম-এর সমালোচনা, বিরুদ্ধতা। কার্ল মার্ক্সকে কেউ বলতে পারেন, সনাতন লিবারালিজ়ম-এর অন্যতম প্রধান সমালোচক। বিষয়টা তাই ভাবার: কী করে এই ভারতে লেফ্ট-লিবারালরা এক দলে হয়ে গেলেন। এর মধ্যে দু’টি প্রশ্ন। কী করে শব্দ দু’টি এক বন্ধনীতে ঢুকে এল, এবং এই জবরদস্তির সহবাস নিয়ে দুই পক্ষের কারও কেন তেমন চিত্তচাঞ্চল্য রইল না।
এ সব ভাবনা মাথায় ঘুরছে, এমন সময়ে পড়া গেল এই বই, সহজ চালে দুরূহ আলোচনায়— গুরচরণ দাস। সারস্বত জোরের সঙ্গে এক সহজ সংযোগের ভাষা তাঁর এই বইতে। বক্তব্য সাজিয়েছেন তিনি দুই পর্বে। প্রথম পর্বে কয়েকটি প্রশ্ন: কাকে লিবারাল বলা যায়। লিবারালিজ়ম-এর একটা ছোট পরিচয়-ইতিহাস কেমন হতে পারে। ভারতীয় লিবারালিজ়ম বলতে কী বুঝি এবং কেন। এই শেষ প্রশ্নে এসে একটি বিশেষ যুক্তি দিয়েছেন গুরচরণ যে, ভারতের জন-সংস্কৃতির মধ্যেই লিবারাল-বাদের উর্বর ভূমি: যে দেশে তেত্রিশ কোটি দেবতাকে পুজো করা হয়, সেখানে ঈর্ষা করার জায়গা কই! বাক্যটিকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন যে সূচিপত্রেই জুড়ে দিয়েছেন তিনি। ভারতকে আগাগোড়া তাই বহু দেবতা আর এক পরম দেবতাকে মেলাতে হয়েছে। রক্তসূত্র, বর্ণসূত্র, ভাষাসূত্রের বৈচিত্রকে জায়গা করে দিতে হয়েছে। চিন্তাবিদদের ভাবতে হয়েছে, কী ভাবে বিশ্বাসের এই বিভেদকে জ্ঞানচর্চা দিয়ে ‘মোকাবিলা’ করা যায়। প্রাচীন কালের দিঙ্নাগ, শবর, কুমারিলা, ধর্মকীর্তি, কিংবা ন্যায়, সাংখ্য, মীমাংসা দর্শন, কিংবা বৌদ্ধ দর্শন, বা ভক্তিবাদের সাম্যসূত্র— এ সব তাই আলোর বর্তিকার মতো ভারতীয় সমাজের একই প্রবণতার দিকে নির্দেশ করে। অতঃপর গুরচরণ বলেন আধুনিক ভারতে কী ভাবে এই ভাবনা লতিয়ে উঠল, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেল ইউরোপীয় মোচড়।
দ্য ডিলেমা অব অ্যান ইন্ডিয়ান লিবারালগুরচরণ দাস
৪৯৯.০০
স্পিকিং টাইগার
বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে স্বাধীন ভারতে লিবারাল মানুষ হিসাবে তৈরি হয়ে ওঠার এক ব্যক্তিগত অভিযাত্রার ২৮টি ‘মাইলস্টোন’। কোন কোন মুহূর্তে উদারনীতির এক-একটি বীজ বপন হয়েছিল তাঁর মনে ও মননে, কিংবা সেই তরুমূলে কখন কেমন আঘাত পড়েছিল, তার কাহিনি।
দু’-একটি মুহূর্তের কথা বলা যাক। ১৯৫৪ সালে দিল্লিতে এক বিশেষ দিনে ইন্ডিয়া গেট থেকে রাইসিনা হিল অবধি স্কুলছাত্র-ছাত্রীদের কুচকাওয়াজের সময়ে নেহরুর সামনাসামনি হওয়ার মুহূর্তটি তাঁর মনে পড়ে। একটা মালা ছুড়েছিলেন নেহরু, তখন যিনি বিরাট সেলেব্রিটি। মালাটা ধরতে পারেননি কিশোর লেখক। এই ফস্কে যাওয়া মালাই যেন প্রতীকী হয়ে উঠল, লেখকের চোখে সে দিনের লিবারাল নায়ক হয়ে উঠলেন এক ‘ওয়েলমিনিং’ কিন্তু ‘ইললিবারাল’ অর্থনীতির প্রবক্তা। গুরচরণের মতের সঙ্গে মিলুক না মিলুক, ক্লাসিক্যাল উদারবাদ থেকে যে সরে গিয়েছিলেন নেহরু, তা মানতেই হয়। কিন্তু আশ্চর্য, সে কথাটা বলার মতো রাজনৈতিক মতাদর্শ রইল না দেশে। পরবর্তী কালে লাইসেন্স রাজের ‘ইললিবারাল’ প্রবণতার কথা উঠে এসেছে আরও একটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে। গুরচরণের তালিকায় আছে— ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের কথা। তিনি বলছেন, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় রাষ্ট্র যে বিরাট প্রতিশ্রুতি তৈরি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে পারত যদি ভারত ‘এশিয়ান টাইগার’দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারত। কিন্তু সেটা হল না, থেমে গেল উদারবাদী অর্থনীতি যাত্রা। আবারও, অনেকেই দ্বিমত হবেন, তবে মানতে হবে লিবারাল অর্থনীতির পরিসর পেতে ভারতকে আরও বিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
এক দিন এক নৃত্যরত নটরাজের মূর্তিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে এক দক্ষিণী নারীকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লেখক যেন ধাক্কা খেয়ে অকস্মাৎ বুঝেছিলেন, যাকে তিনি কুসংস্কার ভাবছেন, তা আসলে এক ‘অন্য’ ধরনের শিল্পমুগ্ধতা। সেকুলার শিল্পবোধ আর ধর্মীয় শিল্পবোধের দূরত্ব যত বেশিই হোক না কেন, সেতু বাঁধতেই হবে। কেননা, কে জানে, তাতে থাকতেই পারে এক বিকল্প সর্বজনীন উদারতার ভাবনা, আবশ্যিক ভাবে যা সঙ্কীর্ণ নয়, ধর্মান্ধ নয়, বরং এক আলাদা বিশ্ববীক্ষা। লেখকের মনে হয়, জার্মান দার্শনিক নিটশে যখন বলেন, “গড ইজ় ডেড”, তখন আসলে তার অর্থ “গড ইজ় ডেড টু মডার্ন সেকুলার ইন্ডিভিডুয়ালস লাইক মি।” এক বিশেষ মতে দীক্ষিত আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের কথাই বলা হয়েছে এখানে, কিন্তু তাঁরাই তো নিরপেক্ষতা বা সর্বজনীনতার একমাত্র ধ্বজাধারক হতে পারেন না। তাঁর মনে হল, সেই দিনটিতে ভারতীয় লিবারাল হিসাবে তিনি ‘ম্যাচিয়োর’ করলেন।
যে ধাক্কাটা তাঁর লেগেছিল, সে ধাক্কা পাঠকেরও লাগে। পাঠকও দেখতে পান, কী ভাবে ‘আধুনিক সেকুলার’ ধ্যানধারণার এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের জায়গাটা থেকেই ভারতে লিবারাল ও লেফ্ট মতাবলম্বীদের এক গোত্রে ফেলে দেন অন্যরা। ক্রমে হিন্দুত্বশাসিত ভারতে লেফ্ট ও লিবারালরা নিজেরাও এই আধুনিক সেকুলার বোধকে ‘কমন ফ্যাক্টর’ ধরে নিয়ে হয়ে ওঠেন এক অভিন্ন গোষ্ঠী। প্রশ্ন হল, এই যে ‘অন্যান্য’রা, এঁদের সকলকেই আবশ্যিক ভাবে ‘ইললিবারাল’ বা অনুদার মার্কা মেরে দিলে সেটা ঠিক হয় কি না।
আসলে বোধ হয়, উদারবাদকে তার নিজস্ব প্রেক্ষিতবিহীন করে দিলে বড় ভুল হয়। ভারতীয় উদারবাদকে হয়তো ভারতের নিজস্ব প্রেক্ষিতে এক ভিন্ন ভাবে প্রোথিত হতে হবে, তাতে তাকে ক্লাসিক্যাল অর্থে কেউ উদারবাদ বলুক না বলুক। এইখানেই গান্ধীর ‘ইউটোপিয়া’র কথা প্রাসঙ্গিক— গুরচরণ বলেছেন। এখানেই নেহরুর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার কথাও প্রাসঙ্গিক— গুরচরণ আলোচনা করেননি। এক বারও নাম করেননি এই বইতে— তবু রবীন্দ্রনাথের সমাজ-ভাবনার কথাও অতি প্রাসঙ্গিক এই সূত্রে। উদারবাদের মধ্যে যে অত্যধিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, তা শেষ অবধি সামাজিক পরিচিতি, সংযোগ ও দায়বদ্ধতার বিপ্রতীপ ও বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়়ায়। এর থেকে আলাদা হয়ে ভারতীয় বাস্তবে বেরিয়ে আসতেই হত সচেতন ভারতীয় চিন্তকদের। আর সে জন্যই কি প্রেক্ষিত-ভিত্তিক নতুন ধারার কথা ভেবেছিলেন তাঁদের অনেকে— যাঁরা আবার নিজস্ব ভাবনায় বেশ গভীর ভাবে ‘লিবারাল’ ছিলেন?
গুরচরণ বলবেন, এই ‘আলাদা হতে পারা’র ধারাটা আজকের দেশে দেখা যায় না। লিবারালরা বিপদের মধ্যে পড়েছেন রাজনীতি ও রাজনীতি ভাবনার সেই সাধারণ দৈন্যের কারণে। এ কেবল বিজেপি-আরএসএস’এর দোষ নয়, কংগ্রেস-বাম দলেরও সমধিক দোষ। রাজনীতির ভারত এখন এমন এক দ্বৈরথের জাঁতাকলে, যেখানে এক দিকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও অতি-জাতীয়তাবাদের নিষ্পেষণ, আর এক দিকে ধর্মের নামোচ্চারণেই অসহিষ্ণুতা, বৃহত্তর স্বার্থের বদলে গোষ্ঠীর স্বার্থচালনা, এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় অবিশ্বাস।
আশার জায়গা রয়ে যায় এ সবের পরেও। এই দুই দিকের মধ্যে আবাদ করে সোনা ফলানোর জন্য পড়ে থাকে বেশ অনেকখানি পরিসর, লেখকের মতে, যে পরিসরে এসে দাঁড়াতে পারে ভারতের ‘লিবারাল সিভিলাইজ়েশনাল টেম্পার’, উদারবাদী মানসতন্ত্র। ‘ইললিবারাল ডেমোক্র্যাসি’র অমোঘতা আমাদের এই মুহূর্তে মুহ্যমান করে রেখেছে। তবুও অন্ধতা মেনে নিয়ে পাখা বন্ধ করা যাবে কি? লিবারালিজ়মের ভাবনা বার বার তুলে ধরা ভাল, তার বহু বিচিত্র সীমা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy