কবিতা নিয়ে নিপাট গদ্যে কিছু লেখা কঠিন। সবার হাতে খোলে না— বেশির ভাগই হাত এবং মুখ দুটোই পোড়ান। বাজারচলতি নোটবইয়ের ভিতর থেকে দুর্ভাগা কবিতার হাহাকার শোনা যায়, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির জেল-হাজতে সেই আর্তনাদ ছাত্রছাত্রীদের মাস্টার করে তোলে। বাইরে কেউ এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না। ছোটবেলা থেকে নাচ-গান-ছড়া-ছবির আনন্দ কে আর বই পড়ে শিখতে যাবে। কবিতাও তেমনই। যার ভাল লাগে, লাগে। তবে কবিতা পড়ার আনন্দ-অভিজ্ঞতা অনেক সময় অন্য পাঠকের সংযোগ চায়। ফরাসি কবি রেনে শার বলেছিলেন, কোনও কবিতার অস্তিত্ব আকাশপটে আঁকা বিমানরেখার মতো। সেই উপস্থিতির ছায়া তলায় সবারই টের পাওয়া উচিত।
কিন্তু বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে এই রকম অভিজ্ঞতা লিখে রাখার একটা পায়ে চলা পথ আছে, সেই দিকে অভীক মজুমদারের কবি আর মুখোমুখি আমি বইটিকে দেখে স্বস্তি পেলাম। অভীক নিজে কবি— কবিতার ভিতরকার কলকব্জা নিয়ে তাঁর নিজস্ব আন্দাজ আছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপকও বটেন। তবু এই তিনটি তকমা টেবিল থেকে সরিয়ে রেখে নেহাত কবিতা-পাঠক পরিচয়ে অভীক আমাদের কাছে হাজির করেছেন তেত্রিশ বছরের পাঠকতার খতিয়ান। দুটো প্রসিদ্ধ কথা এখানে মনে পড়ছে— “কবিতা কিছু বোঝায় না, প্রাণিত করতে জানে”, আর “একমাত্র কবিরাই পারেন সংক্রামকভাবে সাড়া দিতে”। বাংলা কবিতার ‘দুর্বোধ্য পাঠক’কে প্রাণিত করা আর সংক্রমিত করাই অভীকের মূল চেষ্টা। নিজের অনেক দিনের আনন্দময় পথশ্রম তিনি আমাদের জানাতে চাইছেন। ভালবাসা ছাড়া আর কোনও যোগ্যতার দাবি তুলছেন না।
একটা বেয়াড়া কাজের কথা আগেভাগে সেরে নিতে চাই, নইলে আলোচনায় বিঘ্ন ঘটবে। সুদৃশ্য বইটির প্রুফ পর্যায়ে হয়তো কোনও গোলযোগ ঘটে থাকবে— পাতায়-পাতায় অজস্র শব্দ ছাপাখানার বিখ্যাত ভূতের থাপ্পড়ে বেসামাল। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে— এই সমস্যা পরবর্তী সংস্করণে অবশ্যই শুধরে নিতে হবে।
অভীক বইটিকে সাজিয়েছেন কয়েকটি পর্যায়ে। প্রবন্ধের ক্রম লিখনকাল বরাবর নয়। মূলত এ পার বাংলার যে কবিদের নিয়ে অভীক কথা বলছেন, তাঁদের আত্মপ্রকাশ গত শতকের ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যে। আধুনিক বাংলা কবিতার একটি সীমিত সময়ের কবিতা-জিজ্ঞাসা, বিশ্লেষণ এখানে বিন্যস্ত হয়ে আছে। অভীকের বিভিন্ন সময়ের লেখায় অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় চলে এসেছেন ছড়া-কবিতা নিয়ে। শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত আর উৎপলকুমার বসু হাজির হয়েছেন একাধিক প্রবন্ধে। এ ছাড়া টি এস এলিয়ট-এর বিখ্যাত ‘হ্যামলেট’ প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ আর পাবলো নেরুদা বিষয়ে ‘অন্ধকার আর আলোর গান’ লেখা দু’টিতে যুক্ত হয়েছেন ভিন দেশি দুই কবি। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে— ‘হ্যামলেট’ অভীক-এর অনুবাদকাজ, নিজস্ব প্রবন্ধ নয়; বিশেষ কিছু নয়া পর্যবেক্ষণ বা টীকাও অনুবাদক জোড়েননি। আর নেরুদার কবিতা নিয়ে যে সব কথা লেখক বলছেন তার ভিত্তি আর উদাহরণ হিসেবে নির্ভর বাংলা অথবা ইংরেজি অনুবাদ। তা হলে গ্রন্থভুক্তির যুক্তি কী?
কবি আর মুখোমুখি আমি
অভীক মজুমদার
৩৯৯.০০দে’জ়
এখানে একটা উভয়সঙ্কট দেখা দিচ্ছে— অনুবাদে কবিতা যে-চেহারায় ধরা দিচ্ছে, তার উপর বিশ্বাস রেখে মন্তব্য করা চলে কি না? যদি না করি তা হলে বিশ্বকবিতার দরজায় কড়া নাড়তে আমাদের ক’টা ভাষা শিখতে হবে? ‘স্পেশ্যালিস্ট’ ছাড়া কেউ কবিতা নিয়ে কথা বলবেন না? তা হলে আমাদের কবিতার আধুনিকতা বিভিন্ন পর্যায়ে বেসাহারা হয়ে যাবে। বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়র-হ্যোল্ডারলিন-রিলকের আলোচনা বাদ দিয়ে ষাটের দশকের ‘কবি’ ধারণায় সবচেয়ে বড় তরফটি বোঝা শক্ত। তেমনই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্ব-ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা অথবা আফ্রিকার কবিতার বিপুল অনুবাদ ছাড়া পরবর্তী কবিতাচিন্তা বোঝানো অসম্ভব। অভীক তাই নেরুদা বা এলিয়টকে আলোচনা পরিধির মধ্যে এনে আমাদের আধুনিকতার নানা চোরাটানের আভাস রাখলেন।
বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র আর বুদ্ধদেব বসু যেখানে আছেন, উত্তাল চল্লিশের অসমাপ্ত প্রশ্নগুলো সেখানে উঠবেই। অভীকের এই পর্বের সবচেয়ে ভাল লেখাটি সমর সেনকে নিয়ে। কারণ বাঙালি সতর্ক পাঠকের কাছে এই আশ্চর্য মানুষটির কবিতা থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন এখনও নিরুত্তর প্রহেলিকা। অভীক শুধুমাত্র কবিতার ভিতরকার সাক্ষ্যে ভর করে দেখাতে চাইছেন, কী ভাবে সমর সেনের কবিতা থেকে ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় ইমেজ ‘আকাশ’ হারিয়ে যাচ্ছে। এটাই কি হতে পারে কারণ? আমাদের দেশে কবিদের কাগজপত্র, দিনলিপি, চিকিৎসা-তথ্য অসংরক্ষিত। যদি যত্ন করে রাখা থাকত, অভীকের মতো যাঁরা ব্যক্তিজীবন থেকে কবিতা নয় কবিতাসূত্রে কবির সাকিন খুঁজে নিতে চাইছেন, তাঁদের উপকার হত (সমর সেনের কাগজপত্র তা-ও কিছু পাওয়া যায় পুলক চন্দের সম্পাদনায়)। অভীক এই আকাশ-প্রস্থানের ভাবনাটিকে আরও দূরে ঠেলে নিয়ে যেতে পারেন। তাতে শুধু সমর সেন প্রসঙ্গই নয়, চিত্রকল্প নির্মাণের ‘পলিটিক্স’-এরও অনেক হারানো নকশা খুঁজে পাব আমরা।
অভীক বইয়ের পাতায় পাতায় নানা বয়সের তর্কের উপাদান ছড়িয়ে রেখেছেন। খানিকটা কবিতা নিয়ে আড্ডার উত্তেজনায় টেবিল চাপড়ানো ভঙ্গিতে। সেটাও কম নয়। ড্রসোফিলা মাছির মতো বিনবিনে গদ্যে ‘এও হয় তাও হয়’ ধরনের কথা পড়লেই বিরক্ত লাগে। তর্ক জিনিসটা বাংলা কবিতা থেকে বিদায় নিতে বসেছে অনেক দিন হল, সবই অতথ্য মন্তব্য। অভীকের শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা নিবন্ধে আছে এরই উল্টো রাস্তা। কবিতার শব্দ থেকে নানা সূত্র-সমাবেশে চেনা কবিতাকেই নতুন করে পড়ছেন তিনি। সেই কোন কাল থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাঠকমাত্রেই হার্ট ক্রেন, ওসামু দাজ়াই, অথবা জুলেখা ডবসনের অপূর্ব মিল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আছেন— অভীক এখানে সযত্নে টেনে এনেছেন এমন কিছু তথ্য যার সাহায্যে ওই চেনা কবিতা নতুন করে ধরা পড়ে। কী ভাবে এই তিনটি নামের সূত্রে কবিতাগুলোর লিরিক প্রবাহে একটু দূরে ভাসমান স্থায়ী হয়ে থাকে এক আত্মহনন চিন্তা— এ বইয়ের পাঠক টের পাবেন।
বাংলা কবিতার ভাবনাচিন্তায় ছড়া জিনিসটা নিয়ে খুব সিরিয়াস লেখা হাতে গোনা। অভীক এই বইটিতে তিনটি অত্যন্ত দরকারি প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর শঙ্খ ঘোষের ছড়া সত্যিই এখানে বাঘের মতো খেলছে। আইপিএল আর ভোটের বাজার মাথায় রেখে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটা বাঘ ছাড়া যাক: “আউটসুইং মিডল স্টাম্প/ পেট্রোলের ফের বাড়লো দাম।”
যে কবিদের মুখোমুখি আমরা হয়েছি এখানে, তাঁদের মধ্যে যথার্থ ভাবেই সব থেকে বেশি বার দেখা দিয়েছেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। যাঁর নাম চার পাশ থেকে কেবলই মুছে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে হওয়ার নয় তা অভীক বুঝিয়ে দিলেন ‘রিলে রেস’ জারি রেখে। “যে আগুনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তাতে যেন আমার পুণ্য হয়,” লিখেছিলেন প্রণবেন্দু— খাঁটি কবিতাপাঠক কবির সহযাত্রী, দীর্ঘদিন সেই আগুনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে খানিকটা আঁচ অভীক আমাদের উপহার দিলেন।
ধ্বন্যালোক-এর অন্তিম শ্লোকটিতে আচার্য আনন্দবর্ধন বলছেন, সত্যিকারের কাব্যতত্ত্ব সহৃদয় পাঠকের মনে ‘চিরপ্রসুপ্তকল্প’। তাকে সবার জন্য জাগিয়ে তোলা আলোচকের কাজ। অভীকের পরবর্তী চিন্তায় সেই আরব্ধ কাজ নিশ্চয়ই দেখতে পাব আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy