ইতিহাস কী ভাবেই না ফিরে ফিরে আসে! রাসসুন্দরী দাসীর লেখা আমার জীবন এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য— উনিশ শতকে রচিত বঙ্গনারীর আত্মকথা, বাঙালি মেয়ের প্রথম আত্মজীবনী বলে খ্যাত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবনা, দীনেশচন্দ্র সেনের মুখবন্ধ সেই বইকে থিতু করেছে বাঙালির মনে। রাসসুন্দরীর বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৮৭৬, আর কৃষ্ণকামিনী দাসীর লেখা পান্তীর মাঠ-এর পাণ্ডুলিপি তাঁর আত্মজন বিশ্বজিৎ মিত্রের হাতে আসছে ২০০৭ সালে, বই হয়ে বেরোচ্ছে আরও চৌদ্দ বছর পর। রাসসুন্দরী উনিশ শতকের মেয়ে, কৃষ্ণকামিনী বিশ শতকের; দু’জনেরই দীর্ঘ জীবন: (কৃষ্ণকামিনী তো বেঁচেছেন একশো বছর) দু’জনেই দেখেছেন এঁকেছেন বাংলার মেয়েদের সমাজচিত্র— দু’ভাবে। দু’জনেই কন্যা, জায়া, জননী; দু’জনেই ঈশ্বরগতপ্রাণা; তফাত: রাসসুন্দরীর উনিশ শতকীয় সংস্কার ও ‘লজ্জা’য় নারীর প্রেমজীবন রেখেছেন ঊহ্য, এক শতক পরে কৃষ্ণকামিনীর লেখায় সেই প্রেম ‘পূর্ণ প্রকাশিছে’। এই প্রেম পতিপ্রেম নয়, পরপ্রণয়— সমাজচোখে গর্হিত, অবৈধ। বিবাহিতা বালিকা বধূ, এক সন্তানের কিশোরী মা পরিণত বয়সে লিখে গিয়েছেন সেই প্রেমানন্দ ও কলঙ্কভাগিতা দুয়েরই বয়ান, অকপটে।
এই অকপটতা বিস্ময় জাগায়। উত্তর কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে মামাশ্বশুরের বাড়িতে এসে ওঠা, সঙ্গীতপ্রাণ স্বামীর প্রায় সর্বক্ষণ বাইরে পড়ে থাকা, চার দেওয়ালের মধ্যে সন্তানহীনা মামিশাশুড়ির সস্নেহ কিন্তু পিতৃতান্ত্রিকতার পাশবদ্ধ জীবনে আলো হয়ে আসে মামিশাশুড়িরই ভ্রাতুষ্পুত্র, প্রতিবেশী কিশোর মন্মথ। প্রেম কৃষ্ণকামিনীর রচনার শীর্ষবিন্দু বটে, কিন্তু তাঁর লেখা প্রেমসর্বস্ব নয়— এমন নয় যে স্রেফ স্বামীর অবহেলায় বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে ওঠা বিবাহিতা মেয়েটি জড়িয়ে পড়ছে অন্য সম্পর্কে। মন্মথ মেয়েটিকে পড়তে শেখায়, আগল খুলে দেয় তার ভাবনা ও জ্ঞানের। মনেরও। দু’জন দু’জনকে বুঝতে পারার এই নিবিড়তা থেকেই ভালবাসার সহজ, স্বাভাবিক উৎপত্তি। কিন্তু মন্মথ ‘স্বদেশি’ করে, জীবন সে উৎসর্গ করেছে দেশপ্রেমে, তাই এ প্রেমের পরিণতি আজকের ভাষায় ‘স্ক্যান্ডাল’-এ না গড়ালেও ‘ট্র্যাজিক’-ই হওয়ার ছিল। সব জানাজানি হতে যা হয় বাঙালি মেয়ের: নিন্দা, কুৎসা, অপমান, অবসাদ, আত্মহননেচ্ছা। আট বছরের কলকাতাবাস ফেলে গ্রামে আসল শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়া, অন্য এক জীবন শুরু করা, শূন্য থেকে।
পান্তীর মাঠ
শ্রীমতী কৃষ্ণকামিনী দাসী
৩৭৫.০০
অভেদ ফাউন্ডেশন
এই লেখকের ভাষায় নারীবাদের অন্তঃসার সুস্পষ্ট। আসন্নপ্রসবা বধূকে সাহেব হাসপাতাল, না কি আঁতুড়ঘর, কোথায় নেওয়া হবে, তা ঠিক করেন বাড়ির অভিভাবকেরা: “কেহ একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না পর্য্যন্ত... তোর কী মত বল দেখি?” স্ত্রীর অন্য প্রণয় জানতে পেরে স্তম্ভিত স্বামী যখন বলে “তুমি আমাকে বঞ্চনা করিলে?”, এই মেয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার সহিত তোমার কোন সম্পর্ক বর্ত্তমান? তাহা কী প্রণয়ের না অভ্যাসের?” সে পরে লেখে: “কলঙ্কের ভাগী কেবল মহিলাগণই হয় কেন?”
কৃষ্ণকামিনীর লেখা পড়তে পড়তে মনে পড়ে ঘরে বাইরে-র বিমলার কথা। একই রাজনৈতিক ও সামাজিক সময় ধরা পড়েছে দু’টি রচনাতেই, নারীর মানস-উত্তরণের আখ্যানও এই দুইয়েই। পান্তীর মাঠ-এর প্রেক্ষাপট কলকাতা, এই শহরও হয়ে উঠেছে লেখকের জীবনকথার অন্যতম প্রধান এক চরিত্র। বিশ শতকের প্রথম ভাগের, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কলকাতা তার ঘর-বার, লোকাচার-উৎসব-অনুষ্ঠান সমেত ধরা দিয়েছে এক মেয়ের চোখে, সেই দেখাটাও অমূল্য। নারী তথা মানুষের অধিকারের ভাষ্য, আঞ্চলিক ইতিহাসচিত্র— এ বই সবই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy