কর্তত্ব: ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সাহেব ও তাঁর দেশীয় অনুগতরা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কী করে একটা প্রশাসনিক সত্তা হয়ে উঠল, আর্কাইভের নথিপত্রের ব্যবহারে এই বইয়ে তা-ই দেখিয়েছেন শর্মিষ্ঠা দে। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কোম্পানি কী করে প্রশাসন চালাত, অধীন কর্মচারীদের সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কেমন ছিল। লেখিকা শুধু যে এই ‘প্রোটো এম্পায়ার’-এর নানা অংশের আলোচনা করেছেন তা-ই নয়, কী করে তারা এই জটিল নাগরিক শাসনব্যবস্থাটি গড়ে তুলেছিল, কী ভাবে তা এখনকার শাসনব্যবস্থার একটা নীল-নকশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা-ও বোঝানোর প্রয়াস করেছেন। ফিলিপ জে স্টার্ন-এর মতো অনেকে এর শিকড়সন্ধানের চেষ্টা করেছেন আরও আগে, সপ্তদশ শতাব্দীতে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার কর্মী ও সংস্থার কাছে প্রতিষ্ঠানগত ভাবেই ছিল ঠিক একটা ‘সরকার’-এর মতো। লেখিকার মতে যা ‘অবিশ্বাস্য’, স্টার্ন তাকে দেখছেন শাসনকাঠামোর ‘সহজাত’ হিসেবে। শর্মিষ্ঠা মনে করেন, কোম্পানি এ দেশে বিরাট ও জটিল একটা প্রশাসনব্যবস্থা তৈরি করে, খাস ইংল্যান্ডের রাজতান্ত্রিক সরকারের চেয়েও এগিয়ে থাকা এক ব্যবস্থা তৈরি করে নিজের অজানতেই ইতিহাসের একটা হাতিয়ারের কাজ করেছিল।
প্রথম চারটি অধ্যায়ে লেখিকা দেখিয়েছেন, কী করে কোম্পানি খরচ নিয়ন্ত্রণ আর জনকল্যাণের দিকটা মাথায় রেখেও, এমন বিশাল একটা শাসনব্যবস্থা তৈরি করল। প্রশাসনের খরচপত্র যথাসম্ভব কমাতে তারা নিশ্চিত করেছিল যেন কর্মীর বাহুল্য না থাকে। এই নীতির প্রভাব পড়েছিল শাসনব্যবস্থার দুই স্তম্ভ, বিচারব্যবস্থা ও রাজস্ব প্রক্রিয়ার উপরে। লেখিকা দেখিয়েছেন, এই সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা উন্নত পদক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছিল, এমনকি গ্রেট ব্রিটেনের সরকারের থেকেও অনেক বেশি। তাদের ছিল জাতপাত ও অন্যান্য অনুক্রম ভিত্তিক এক বহুস্তরী শ্রমশক্তি। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি শাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ঔপনিবেশিক সরকার কী ভাবে এক স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, শর্মিষ্ঠা তা বিশদে আলোচনা করেছেন।
প্রথম অধ্যায়ে লেখিকা দেখান, ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময় থেকে কী করে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, লর্ড কর্নওয়ালিসের অধীনে কী ভাবে তৈরি হয় তার উপরকাঠামো। কোম্পানির সামগ্রিক শাসননীতির সঙ্গে সময়ে সময়ে স্থানীয় সনিষ্ঠ প্রশাসকদের কেমন বিরোধ বাধত, সেই সময়ের চিঠি ও আবেদনপত্রের নথির উদ্ধারে দেখানো হয়েছে পরের অধ্যায়ে। উচ্চপদস্থরা কেবল ব্যয়সঙ্কোচ নিয়েই ভাবিত ছিলেন, আর স্থানীয় প্রশাসকেরা— যাঁরা ছিলেন প্রকৃত অর্থে শ্রমশক্তির নিয়ামক— চাইতেন একটা উচ্চ মান বজায় রাখতে; স্থানিক প্রয়োজন অনুসারে অতিরিক্ত পদ বা আর্থিক সহায়তার জন্য করা তাঁদের নানা আবেদন থেকেই তা স্পষ্ট। দুই স্তরের মধ্যে এই যে বিভাজন, লেখিকা তা চমৎকার তুলে ধরেছেন। এই বিভাজন আসল ব্রিটিশ সরকারের পরস্পরবিরোধী নির্দেশিকার মধ্যেই নিহিত ছিল— এক দিকে ঋণ কমিয়ে আনার জন্য জোর করা, আবার অন্য দিকে কোম্পানিকে নতুন নতুন উদ্যোগ করতে উৎসাহ দেওয়া যাতে লাভের অঙ্ক বাড়ানো যায়।
হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন দ্য ডেজ় অব জন কোম্পানি: ১৭৯০-১৮৫০শর্মিষ্ঠা দে
৬৯৫.০০
থিমা
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখিকা দেখান, কোম্পানি কী করে ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, নগরায়ণ, তথ্য-সংগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক ধরনের উদারবাদী কর্তৃত্ববাদের পন্থা অবলম্বন করে নিজেদের প্রভাব ও সংযোগ বাড়িয়ে তুলেছিল। ইউরোপীয় ও নেটিভ শ্রমশক্তির জাতিবিভাজনের লক্ষ্মণরেখা কী ভাবে আঁকা হয়েছিল, তা ফুটে উঠেছে চতুর্থ অধ্যায়ে: যদিও পারস্পরিক নৈকট্যের কারণে এই সীমা প্রায়ই লঙ্ঘিতও হত, এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ বা শাস্তিবিধানে সেই লঙ্ঘন মুছেও দেওয়া হত। সুলিখিত এই অধ্যায়টি দেখায়, স্বাধীন ভাবে কাজ করার যে নৈতিক মূল্যবোধকে নাগরিক গুণাবলির পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হত, তা এসেছিল ‘স্কটিশ আলোকপ্রাপ্তি’-র ধারণা থেকে: এর ফলে নেটিভ ও ইউরোপীয়দের সরকারি ও ব্যক্তিগত পরিসরকে আলাদা করে দেখা, শাসকের থেকে বণিককে আলাদা করে দেখার ধারণা তৈরি হয়েছিল। শুধু নৈতিকতাই নয়, পোশাকআশাক, জীবনযাত্রা, চালচলন, কাজের মান, এই সব কিছুও এর ফলে খতিয়ে দেখা হত। শেষ দু’টি অধ্যায়ে লেখিকা দেখান, ছুটি ও পেনশনের মতো আধুনিক নিয়মগুলি কী ভাবে এই সময়ে গড়ে উঠল, সমসময়ের ইংল্যান্ডের থেকেও কী ভাবে তা এগিয়ে ছিল।
ইউরোপীয় কর্মীদের অবকাশ যাপনের সুযোগ করে দেওয়া এই ছুটির নিয়মগুলি অবশ্য ভারতীয় কর্মচারীদের জন্য ১৮৫৭ সালে তৈরি করা কোম্পানির নিয়মের থেকে আলাদা ছিল। নিয়মগুলি ছিল জটিল কিন্তু উদার, কর্মীদের দাবিদাওয়া ও সরকারের প্রত্যাশার মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা ছিল সেখানে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে কোম্পানি সরকারের পেনশন নীতি নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। গোড়ার দিকে পেনশন দেওয়া হত শুধু সেনাকর্মী ও চুক্তিবদ্ধ পরিষেবার কর্মীদের, কিন্তু পরে পরে তা জনপ্রশাসনের নীচের দিকের স্তরের কর্মীদেরও দেওয়া শুরু হয়। লেখিকা উদাহরণ সহযোগে দেখিয়েছেন, পেনশন নীতি কী ভাবে মালিক ও কর্মিপক্ষের সম্পর্কে এক ধরনের আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের পরিসর তৈরি করেছিল। প্রথম দিকে কেবল ইউরোপীয় সরকারি কর্মচারীদের সুবিধায় করা হলেও, পেনশন-সংক্রান্ত সুবিধাগুলি ক্রমে দেশীয় কর্মচারীদের জন্যও প্রসারিত হয়— এ ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের সরকারের চেয়ে ঢের আগে। কোম্পানি শাসনের আগে থেকেই যে রাজারাজড়া, জমিদার, স্থানীয় সামন্তপ্রভুরা ছিলেন, সপরিবার তাঁদের জন্যও এই পেনশনের মতো মাসোহারা বরাদ্দ করা হয়, এ দেশে কোম্পানির রাজত্বের প্রতি তাঁদের নৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
লেখিকা তাঁর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য আর্কাইভের নথিপত্রের অনুপুঙ্খ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, কোম্পানির চালু করা ‘উদ্ভাবন’গুলি সমসাময়িক ইংল্যান্ড সরকারের নীতির তুলনায় ছিল মানবিক এবং ‘আধুনিক’। বস্তুত সেগুলি ১৯৪৭ সালে নবগঠিত ভারতরাষ্ট্রের নানা নীতির ভিত্তিপ্রস্তরও তৈরি করে দিয়েছিল। শুধু দু’টি দিক নিয়ে স্পষ্টতর আলোচনা করলে আরও ভাল হত— আদি আধুনিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘সাম্রাজ্য’-এর অভিযাত্রায় কোনও ফাঁক বা বিরতি নেই, ফিলিপ স্টার্ন-এর এই মতের সঙ্গে তিনি সহমত কি না, এবং জন কোম্পানি কী করে দেশীয় কর্মচারীদের দাবিদাওয়া ও অসন্তোষ নিয়ে দর-কষাকষির মধ্যেও ক্রমাগত ‘হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ চালিয়ে গিয়েছিল, সেই দিকটি। উপনিবেশ-বিরোধী ইতিহাস-রচনার গুরুভার থেকে সরে এসে, লিখিত নথিপত্রের প্রমাণ পেশ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখিকা, তা এক নতুন পথের দিশা দেখাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy