যাঁরা মুসলিম বিশ্ব নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের কাছে জিয়াউদ্দিন সর্দার এক সুপরিচিত লেখক। মাত্র তেষট্টি বছর বয়সে উনি ইসলাম, বিজ্ঞান, উত্তর আধুনিকতা ও সমসাময়িক সংস্কৃতি নিয়ে পঞ্চাশের উপরে বই লিখেছেন। গত সাড়ে তিন দশক ধরে নিরলস গবেষণার ফল হল তাঁর ওই অনন্য কৃতিত্ব। সর্দার এমন একজন প্রখর সর্বজনবিদিত বুদ্ধিজীবী যাঁর কসমোপলিটান ও সমালোচনামূলক ভাবনা চিন্তাশীল মানুষকে নাড়া দেয়। দশ বছর আগে প্রকাশিত ওঁর ডেসপারেটলি সিকিং প্যারাডাইস: জার্নিস অফ আ স্কেপ্টিকাল মুসলিম বইটা পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়।
আলোচ্য বইটি, যার শিরোনাম বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মক্কা: এক পবিত্র শহর আর একটা চমৎকার বই। ডেসপারেটলি সিকিং প্যারাডাইস-এ স্মৃতি রোমন্থনের সঙ্গে উপমার সাহায্য নিয়ে সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে বক্তব্য ছিল। কিন্তু এই বইয়ে লেখক এক দীর্ঘ ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য ভাষায় লেখা এক লোকপ্রিয় ইতিহাস। বইটি একই সঙ্গে মক্কা শহরের প্রাচীন ও নবীন ইতিহাস যা লেখা হয়েছে সাধারণ পাঠককে মাথায় রেখে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে লেখক পণ্ডিতসুলভ পুথি ও কেতাবি গবেষণাধর্মী পুস্তককে অবজ্ঞা করেছেন। বরং ছত্রে ছত্রে দুর্দান্ত সব গবেষণামূলক বইয়ের সাহায্য তিনি নিয়েছেন।
সেই সব গবেষণামূলক বইয়ের লেখক যেমন কিছু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিত তেমনই মধ্যযুগের কিছু মৌলিক ও বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। লেখক তাঁর বইয়ে আল-তাবারি, ইবন ইসাক, আল-ওকিদি, ইবন বাত্তুতা, ইবন খালদুন, ইবন আল-মুজাবির, ইবন আল-আরাবি, আল-ফারাবি, ইবন জুবাইর, ইবন খাতির প্রভৃতির ইংরেজি তর্জমা ব্যবহার করেছেন। উপরে উল্লেখিত আরব ও পারস্যের লেখকগণ কেউ বিদগ্ধ ঐতিহাসিক তো কেউ ভ্রমণকাহিনীর জন্য বিখ্যাত। আবার কেউ বা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের জীবনীকার। যাঁরা মধ্যযুগের সঙ্গে কেবলমাত্র ‘অন্ধকার’ এবং ‘বর্বর’ ইতিহাসের তুলনা করেন আর অন্য দিকে মুসলিমদের সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, তাঁরা ওই সব বরেণ্য মুসলিম ব্যক্তিত্বের ইংরেজি তর্জমা বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন। আর ওই বইগুলো না পেলে নিদেনপক্ষে এই বইটা পড়তে পারেন।
মক্কার ইতিহাস বলতে গিয়ে লেখক অবধারিত ভাবে ইসলামি ইতিহাসকেও সমান্তরাল ভাবে বলেছেন এক বিশ্বাসী মুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে। লেখক প্রাচ্যবাদী (ওরিয়েন্টালিস্ট) কিছু ঐতিহাসিকের গবেষণাকে ব্যবহার করলেও প্রাচ্যবাদকে (ওরিয়েন্টালিজম) প্রশ্রয় দেননি। আজকের পৃথিবীতে যেখানে ইসলাম সম্পর্কে বিদ্বেষ, একপেশে মনোভাব ও অযথা ভীতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেখানে ইসলামি ইতিহাস নিয়ে এমন একটা বইয়ের প্রয়োজন ছিল। লেখক একের পর এক গল্প বলে চলেছেন। আবার গল্পের মতো করে তিনি ইতিহাস বলে চলেছেন। লেখক এক দিকে যেমন ইসলামি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার ধারাবিবরণী দিয়েছেন তেমনই কোরান ও বুখারির নথিভুক্ত হাদিস (পয়গম্বরের জীবন ও বাণী) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। মক্কার কোনও দুর্জ্ঞেয় ইতিহাস তিনি রচনা করেননি। আবার ইসলামের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি অতিকথন করেননি। যথাসম্ভব একটা আবেগহীন পক্ষপাতহীন ইতিহাস তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বইয়ের শেষে একটা তথ্যদায়ক ঘটনাপঞ্জি আছে যা শুরু হচ্ছে আব্রাহামের (মুসলিম মতে ইব্রাহিম) মক্কায় ‘কাবা’ নির্মাণ (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৮১২-১৬৩৭) থেকে। কাবা সম্পর্কে বিবলিওথেকা হিস্টোরিকা-য় উল্লেখ করছেন গ্রিক ঐতিহাসিক দিয়োদরুস সিকুলুস (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০) এবং টলেমি তাঁর ‘ভূগোল’-এ (প্রায় ৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দে)। ওই শিক্ষামূলক ঘটনাপঞ্জি শেষ হচ্ছে ২০১১ সালে যখন মক্কার মসজিদের জায়গা বাড়িয়ে কুড়ি লক্ষ মানুষের প্রার্থনা করার (নামাজ পড়ার) পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মাঝের দুহাজার বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়েই লেখক ক্ষান্ত হননি। বরঞ্চ চৌদ্দোশো বছরের ইসলামি ইতিহাসের উত্থানপতন, মক্কা শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে কলঙ্কময় অধ্যায়ের বিষয়েও বিশদ বক্তব্য আছে। পাঠককে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা এই বইয়ের আছে।
বইয়ে এগারোটা মূল অধ্যায় আছে, ৩৬৩ পৃষ্ঠা জুড়ে। তার আগে ৩৮ পৃষ্ঠার ভূমিকায় মক্কার উপরে গবেষণা করতে গিয়ে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। লেখক পরিষ্কার করে বলেছেন যে মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলগুলো মাঝে মাঝে বিভিন্ন শহরে সরে যায়। উদাহরণস্বরূপ লেখক দেখিয়েছেন যে খারেজিদের হাতে চতুর্থ খলিফা আলির হত্যার পরে উম্মায়াদ শাসনকালে (৬৬১-৭৫০), দামাস্কাস নতুন রাজধানী হয়। পরে আব্বাসিদ জমানায় (৭৪৯-১২৫৮) সেই রাজধানী সরে যায় বাগদাদে। এর পর অটোমান সাম্রাজ্যের সময় (১২৯৯-১৯২২) ইস্তানবুল মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। তার মাঝে মুসলিম বিশ্বের আরও কিছু বড় শহর যেমন কায়রো, ফেজ, টিউনিস, গ্রানাদা, কর্ডোবা, টিম্বাকটু, সমরখন্দ, বুখারা, দিল্লি ও লাহৌরের উত্থান ও পতন ঘটেছে। এমতাবস্থায় লেখক দেখিয়েছেন যে মক্কা কী করে ধর্মীয় রীতির জন্যই প্রতিনিয়ত মুসলিম জীবনের কেন্দ্র হয়ে আছে।
লেখকের মৌলিকত্ব হল যে তিনি মক্কার কোনও আদর্শস্বরূপ বা কল্পিত ইতিহাস রচনা করেননি যদিও মক্কা মুসলিম মননে এক আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ শহর হিসেবে কী ভাবে কল্পিত হয় সেই বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। লেখকের নিজের ভাষায় ‘মক্কার ইতিহাস পৃথিবীর যে কোনও শহরের মতো এক ভয়ানক রক্তাক্ত ইতিহাস’। এ ক্ষেত্রে লেখকের একটা খামতি হল যে তিনি সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম জনতার একাংশের বিদ্রোহের বিবরণী দিলেও তাকে ‘ভ্রাতৃঘাতী’ বলে অভিহিত করেননি। অথচ তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষমতা দখলের যে ধারাবিবরণী দিয়েছেন তাকে ‘ভ্রাতৃঘাতী’ বলে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফা উমর এবং ওসমানের হত্যার ঘটনায় তিনি বিশেষ আলোকপাত করেননি। অথচ একই যুক্তিতে সেই হত্যাগুলো ও পরবর্তী কালে আলি, হুসেন ও হাসান-এর হত্যালীলাকে কেনই বা ‘ভ্রাতৃঘাতী’ বললেন না? লেখক প্রাথমিক ঐতিহাসিক দলিল ও মৌলিক গবেষণামূলক পত্রপত্রিকার চেয়ে অপ্রধান গবেষণামূলক বইয়ের উপরেই মূলত নির্ভর করেছেন। সেই সব পুস্তকবিবরণী ও গ্রন্থপঞ্জি বইয়ের শেষে না দিয়ে মূল পৃষ্ঠার নীচে ফুটনোট আকারে দিলে আরও পাঠকবান্ধব হত।
ঠিক চার দশক আগে, সর্দার তাঁর জীবনের প্রথম হজ করেছিলেন, ১৯৭৫ সালে। মক্কায় কর্মরত অবস্থায় তিনি পাঁচ বছর ধরে বাৎসরিক ও সারা বছর চলতে থাকা তীর্থ, ‘উমরাহ’কে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করেছেন। বইটা তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। ঠিক যেমন কোনও তীর্থ যে কোনও ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে মক্কার বার্ষিক হজ তেমনই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ মুসলমান মক্কায় হজ করতে যাবেন। হজ যাত্রীরা একবার এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন। যাঁরা হজে যেতে অপারগ বা যাঁরা ইসলাম ধর্ম মানেন না তাঁরা এই বই পড়ে মক্কা শহর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবেন। যাঁরা কোনও ধর্মই মানেন না অথবা নাস্তিক, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy