বার বার কেন নিশানায় ‘সোনার বাংলা’। — গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২৯ অগস্ট, ২০২৩ • রানাঘাটে সোনার দোকানে ডাকাতি
সেই ঘটনায় পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন গ্রেফতার। ধৃত মূল পাণ্ডা কুন্দন বিহারের বাসিন্দা। বাকি দু’জনের বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। বাকি দু’জনও বাংলার বাইরে থেকেই আসা বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
২৯ অগস্ট, ২০২৩ • পুরুলিয়া শহরে সোনার দোকানে ডাকাতি
ধৃত করণজিৎ সিংহের বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। মূল চক্রী ভিন্রাজ্যের জেলে বন্দি। তাঁরও বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। রানাঘাটে ডাকাতিতে মূল অভিযুক্ত কুন্দনের ‘গুরু’।
৯ জুন, ২০২৪ • রানিগঞ্জে সোনার দোকানে ডাকাতি
ধৃত সুরজকুমার বিহারের বাসিন্দা। অপর ধৃত সোনুর বাড়ি বিহারের সিওয়ানে।
১১ জুন, ২০২৪ • ডোমজুড়ে সোনার দোকানে ডাকাতি
অধরা সকলেই। পুলিশের অনুমান, এ ক্ষেত্রেও ডাকাতেরা বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো ভিন্রাজ্যের বাসিন্দা।
গত বছর একই দিনে দুই শহরে একই ‘প্যাটার্নে’ ডাকাতি। এ বার দু’দিনের ব্যবধানে একই কায়দায় দু’জায়গায় দুই সোনার দোকানে ডাকাতি। ডাকাতি করার ধরন বাদ দিলে উপরের চারটি ঘটনায় রয়েছে আরও একটি মিল। তা হল, অভিযুক্তদের বাসস্থান। সাম্প্রতিক কালে বাংলার সোনার দোকানগুলিতে যত বার ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সিংহভাগ ক্ষেত্রে নাম জড়িয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী দুই রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের। ডোমজুড়ে সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় এখনও গ্রেফতার করা যায়নি কাউকে। যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, অভিযুক্তেরা কেউই এ রাজ্যের নন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কেন বার বার বিহার, ঝাড়খণ্ডেরই নাম জড়াচ্ছে বাংলার সোনার দোকান লুটে?
মঙ্গলবার হাওড়ার ডোমজুড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘অপারেশন’ শেষ করে মালিককে হিন্দিতে ‘কী করবি করে নে’ (জো উখাড়না হ্যায়, উখাড় লে) বলে শাসিয়ে গয়না নিয়ে বেরিয়ে যায় ডাকাতেরা। পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, ঝাড়খণ্ড বা বিহার থেকে এসেছিল তারা। এই প্রসঙ্গে ডোমজুড়ের সোনার দোকানের এক কর্মী পুলিশকে জানিয়েছেন যে, শীতের সময় এক মহিলার সঙ্গে তাঁদের দোকানে এসেছিল ডাকাতদলের এক জন। গয়নাও কিনেছিল। তাই মঙ্গলবার যখন ডাকাতেরা খদ্দের সেজে দোকানে আসে, তখন ওই ব্যক্তিকে দেখে আর সন্দেহ হয়নি কর্মীদের। অর্থাৎ, ডাকাতির ছক কষা হয়েছিল বহু দিন আগে। তার পর নিয়মিত চলেছে রেকি।
ঠিক দু’দিন আগে, একই ধরনের ঘটনার সাক্ষী হয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জও। সেই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যেই দু’জনকে গ্রেফতারও করছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, ধৃত সুরজ এবং সোনু দু’জনেই বিহারের বাসিন্দা। পুলিশ আধিকারিক মেঘনাদ মণ্ডলের ছোড়া গুলি লেগেছিল এই সোনুর কোমরেই। আবার, গত বছর অগস্টে যখন একই দিনে পুরুলিয়া শহর এবং নদিয়ার রানাঘাটে একই স্বর্ণ বিপণি সংস্থার শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে, তাতেও দেখা গিয়েছে ধৃতদের বাড়ি সেই বিহার, ঝাড়খণ্ডেই। অর্থাৎ, বাংলার একাধিক সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় বার বারই উঠে এসেছে বিহার, ঝাড়খণ্ড যোগের কথা। এই যোগসূত্রেরই খোঁজে আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলে একাধিক প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে। কেন বার বার বিহার, ঝাড়খণ্ডের ‘গ্যাং’-এর নজর গিয়ে পড়ছে ‘সোনার বাংলা’র দিকে? এর মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র রয়েছে?
পুলিশ আধিকারিকেরা বলছেন, আগে দেখা যেত ডাকাতি হচ্ছে ব্যাঙ্কে। কারণ, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত থাকে প্রচুর নগদ টাকা। এক বার নিরাপত্তার বেড়াজাল ভাঙতে পারলে বিপুল নগদ হস্তগত হয়। কিন্তু ইদানীং তাতেও সমস্যা! নগদের ব্যবহার কমিয়ে এবং সামগ্রিক ভাবে ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা ধাপে ধাপে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, সেখানে ডাকাত পড়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। গৃহস্থের বাড়িতেও ডাকাতি করে ‘লাভের’ তুলনায় ঝুঁকির পরিমাণ বেশি। তাই, তুলনায় সহজ নিশানা মফস্সলের সোনার দোকান। কিন্তু কেন? পুলিশকর্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, মফস্সল শহর হওয়ায় সোনার দোকানের নিরাপত্তা থাকে অপেক্ষাকৃত ঢিলেঢালা। ওই দোকানে ঢুকে গয়না লুট করা সুবিধাজনক। ডাকাতদের হাতে বিশেষ সময়ও থাকে না। ফলে কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে কাজ হাসিল করতে সোনার দোকানকে বেছে নেওয়া হয়। তদন্তকারীরা মনে করেন, যে হেতু সোনার দাম বরাবরই আকাশছোঁয়া, তাই পরিমাণ মতো সোনা লুট করা গেলে তা নগদ লুটের চেয়েও বেশি সুবিধাজনক। প্রয়োজন মতো সোনা গলিয়ে অন্যত্র পাচার করা যায়। তাই, কম ঝুঁকিতে বড় কাজ হাসিল করতে সোনার দোকানকে নিশানা বানায় ডাকাতেরা। রানিগঞ্জের ক্ষেত্রে ডাকাতেরা নিয়মিত রেকি করে জানতে পারে যে, শনিবারই ওই দোকানে এসে পৌঁছেছে নতুন গয়নার সম্ভার। ফলে রবিবার দোকানে ডাকাতি করা গেলে অনেক বেশি লাভের সম্ভাবনা। ঘটনাচক্রে, ওই দোকানে যে ব্যাগে করে গয়না পৌঁছনো হয়েছিল, সেই ব্যাগটি ধরেই নিয়ে যায় ডাকাতেরা। রানিগঞ্জে সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক আইপিএস অফিসার বলছেন, ‘‘অল্প পরিমাণ সোনা হাতিয়ে নিতে পারলে একসঙ্গে অনেকটা টাকা পাওয়া যায়। সহজেই গলিয়ে তাকে ছোট-বড় যে কোনও সোনার দোকানে বিক্রিও করা যায়।’’ ওই আইপিএস অফিসার আরও বলেন, ‘‘এই চক্র বড় চক্র। জলদস্যুদের যেমন বড় বড় চক্র হয়, তেমনই সোনার দোকানের ডাকাতদেরও বড় চক্র থাকে। তারা গোটা বিষয়টি সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে কাজ শুরু করে।’’
কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সংস্থারই সোনার দোকানের শাখায় ডাকাতি হচ্ছে বার বার। তারই বা কারণ কি? প্রাক্তন এক সিআইডি কর্তার মতে, ডাকাতদের একটি নির্দিষ্ট স্বর্ণ বিপণিকেই নিশানা করার পিছনে রয়েছে রেকি করে সংগ্রহ করা কিছু তথ্য। যেমন, বেশির ভাগ চোখধাঁধানো স্বর্ণ বিপণিতে ‘ডিসপ্লে’ বা দোকানে প্রদর্শনের জন্য শোকেসে রাখা গয়না আসল সোনার হয় না। তার বদলে রাখা থাকে ইমিটেশনের গয়না। আসল মালপত্র গচ্ছিত থাকে সিন্দুকে বা ভল্টে। কিন্তু রেকি করে ডাকাতদল জানতে পারে, রানাঘাট, পুরুলিয়া বা রানিগঞ্জে যে স্বর্ণ বিপণি সংস্থার দোকান, সেখানে ‘ডিসপ্লে’তেও রাখা থাকে আসল গয়না। তাই, ওই দোকানে ঢুকে গয়না লুট করা অপেক্ষাকৃত কম সময়সাপেক্ষ। ডাকাতদের হাতে বিশেষ সময়ও থাকে না। সেই সামান্য সময়ের মধ্যে ভল্ট ভাঙা যথেষ্ট কঠিন। পক্ষান্তরে, ‘ডিসপ্লে’তে আসল গয়না রাখা থাকলে আর ডাকাতেরা ভল্ট ভাঙার ঝুঁকি নেয় না।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, বিহার-ঝাড়খণ্ডের গ্যাং ডাকাতি করার আগে ভাল করে এলাকায় রেকি করে। এ কাজে তাঁদের সাহায্য নিতে হয় আরও অনেকের। পুলিশের ওই সূত্রের মতে, অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয় মূলত জেল থেকে। সেই সম্পর্ক ‘কাজে লাগে’ জেল থেকে বেরোনোর পরে। ঠিক যেমন, গত বছর অগস্টে রানাঘাট এবং পুরুলিয়ায় জোড়া ডাকাতির ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছিল যে, পুরুলিয়ার দোকানে ডাকাতির ঘটনার মূল পাণ্ডা, যিনি বর্তমানে অন্য মামলায় ভিন্রাজ্যে জেলবন্দি, সেই তিনিই আবার রানাঘাটে ডাকাতির মূলপাণ্ডা কুন্দনের ‘গুরু’। শোনা যায়, জেলেই দু’জনের আলাপ এবং পরবর্তী কালে সেই আলাপ গড়ায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে! এ ছাড়াও, যে এলাকায় ডাকাতির ছক কষা হয়, সেই এলাকার ধারেকাছে ওই গ্যাংয়ের কোনও সদস্যের কোনও আত্মীয় বা বন্ধু থাকেন কি না তারও খোঁজ নেয় ডাকাতেরা। আত্মীয়ের সন্ধান পাওয়া গেলে সেই বাড়িতে ঘুরতে পাঠানো হয়। বেড়ানোর নাম করে এলাকার রেকি করে নেওয়া হয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। রানিগঞ্জের সোনার দোকানে ডাকাতির ক্ষেত্রেও পুলিশ খুঁজে দেখছে, ওই এলাকায় ধৃতদের কোনও আত্মীয়-বন্ধু থাকেন কি না।
কিন্তু কেন বার বার বাংলা? পুলিশকর্তারা মনে করছেন, তুলনামূলক ভাবে বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের চেয়ে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল বাংলা। এই রাজ্যের বাসিন্দাদের হাতে ওই দুই রাজ্যের তুলনায় বেশি টাকা থাকে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাস তুলনায় দুই রাজ্যের চেয়েই বেশি। ফলে সোনার দোকানে কেনাকাটার পরিমাণও প্রতিবেশী দুই রাজ্যের চেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি বিষয়। কলকাতার বড় বড় সোনার দোকানে যে রকম নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা থাকে, মফস্সলে ব্যাপারটি তেমন নয়। সেখানে সোনার দোকানে নিরাপত্তারক্ষী থাকেন বটে, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই নিরস্ত্র অবস্থায়। তাই সেখানে নিশানা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। ঠিক যেমন দেখা গেল ডোমজুড়ে সাম্প্রতিকতম ডাকাতির ঘটনায়।
তবে, ডাকাতদের নিশানায় যে কেবল বাংলারই সোনার দোকান, বিষয়টি তেমন নয় বলেই জানাচ্ছেন পুলিশ আধিকারিকেরা। গত বছর মে মাসে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে রেলগেটের কাছে একটি সোনার দোকানে ডাকাতি এবং গুলি করে ওই দোকানের মালিক নীলরতন সিংহের ছেলে নীলাদ্রিকে খুন করার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার তদন্তে নেমে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা জানতে পারেন, বিহারের বাসিন্দা রাজবীর সিংহ ওরফে অবিনাশ এই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত। গত ১২ জুন পঞ্জাবের মোগা থানা এলাকায় একটি সোনার দোকানে হুবহু ব্যারাকপুরের কায়দায় লুট ও খুন করেছিল রাজবীরের দল। সেখান থেকে এক কোটি টাকা লুট করে বিহার ও মহারাষ্ট্রে ছড়িয়ে যায় তারা। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সেখানে হানা দেয় পঞ্জাব ও বিহার পুলিশ এবং ব্যারাকপুর কমিশনারেটের তদন্তকারীরা। ধরা হয় রাজবীরকে। ফলে, বিহার, ঝাড়খণ্ডের ডাকাতদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বাংলা, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, বিহার, ঝাড়খণ্ডের ডাকাতদের নজর থাকে মূলত আর্থিক ভাবে সচ্ছল এলাকার উপরেই। বাংলার পাশাপাশি যে সচ্ছলতার দেখা মেলে আরও একাধিক রাজ্যে। সেই সচ্ছলতার গন্ধেই ভিন্রাজ্য থেকে উড়ে আসে ডাকাতের দলও।