Panchyat Election 2023

সাগরদিঘির বিশ্বাস রইল তৃণমূলেই, উপনির্বাচনে ওঠা ঢেউ কেন মিলিয়ে গেল পঞ্চায়েত নির্বাচনে?

বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে উপনির্বাচনের ফলাফলের কোনও মিলই ছিল না। মুরিশিদাবাদের সাগরদিঘি নতুন নজির তৈরি করেছিল গত মার্চ মাসে। আবার সেই ফলের সঙ্গে কোনও মিল নেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে।

Advertisement
পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ১৫:৫৮
Sagardighi

সাগরদিঘিতে সবার উপরে ঘাসফুল। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়ে সাগরদিঘিতে জয়ী বাইরন বিশ্বাস আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাগরদিঘির বিশ্বাসও গেল তৃণমূলের পক্ষেই। মার্চ আর জুলাইয়ের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। মার্চে উপনির্বাচনের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূলকে ২৩ হাজার ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। আর জুলাই মাসে সেই সাগরদিঘিরই পঞ্চায়েত নির্বাচন বলছে, তৃণমূলই প্রধান শক্তি। কয়েক মাস আগে সাগরদিঘির জলে তরঙ্গ তোলা কংগ্রেস বা সিপিএম তুলনায় দুর্বল। বিরোধী জোট একটি মাত্র পঞ্চায়েত দখল করার শক্তি পেতে পারে। বাইরন বলছে, এর সব কৃতিত্ব তাঁরই! তাঁর পুরনো দল কংগ্রেস বলছে, ভোটই হয়নি তো তার ফল!

সাগরদিঘির ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে শুধু পাটকেলডাঙা বাম-কংগ্রেসের হাতে থাকার সম্ভাবনা। অন্য দিকে মোড়গ্রাম, সাগরদিঘি সহ আরও দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত একক ভাবে জিতেছে তৃণমূল। বাণেশ্বর, বোখরা-১, বোখরা-২, বালিয়া, কাবিলপুর ও গোবর্ধন গ্রাম পঞ্চায়েত আপাতত ত্রিশঙ্কু।

Advertisement

মোট আসনের বিচারে সাগরদিঘি ব্লকের ২৭১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে তৃণমূল ১০৯টি জিতেছে। দ্বিতীয় কংগ্রেস। তারা পেয়েছে ৩৬টি। বামেরা ২০, বিজেপি ১৮, নির্দল ৯ এবং একটির ফল অমীমাংসিত। পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩টি আসনের মধ্যে ২৩টিতেই জিতেছে তৃণমূল। ন’টি পেয়েছে কংগ্রেস এবং একটি বিজেপি। জেলা পরিষদের তিনটি আসন রয়েছে সাগরদিঘিতে। আরও একটি আসনের অর্ধেক ওই বিধানসভা এলাকায়। সবক’টিই পেয়েছে তৃণমূল।

সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল নিঃসন্দেহে শাসক তৃণমূলের কাছে বড় ধাক্কা ছিল। কারণ, সেটি ছিল ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরে প্রথম একটি উপনির্বাচনে শাসকদলের পরাজয়। তা-ও আবার বিধানসভা ভোটে ৫০ হাজারের বেশি ভোটে জেতা আসনে। ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, পৌনে দু’বছর আগে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাগরদিঘিতে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৫,১৮৯টি ভোট। সেটা কমে হয় ৬৪,৬৩১। অর্থাৎ তৃণমূলের ভোট কমে ৩০,৫৫৮টি। আবার বিজেপির ভোট ৪৪,৯৮৩ থেকে কমে হয় ২৫,৭৯৩। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় হয়ে যায় তারা। আর কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৩৬,৩৪৪ থেকে বেড়ে ৮৭,৬১১ হয়।

মাত্র চার মাস ১০ দিনের মাথায় পরিস্থিতি একেবারে উল্টো! তবে মাঝে একটা বড় বদল এসেছে। ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির মধ্যেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের বাইরনকে নিয়ে আসেন তৃণমূলে। তারই ফল পেল শাসক শিবির? স্বয়ং বাইরনের তেমনই দাবি। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমি আগেই বলেছিলাম, আমি যে দিকে যাব, জনসমর্থনও সে দিকে যাবে। আমার চ্যালেঞ্জে আমি সফল হয়েছি। দল পরিবর্তন করেছিলাম মানুষের জন্য। এ বার মানুষ সেটার স্বীকৃতি দিয়েছেন।’’ জেলা তৃণমূলও অবশ্য মনে করছে, উপনির্বাচনে দল বা জোটের চেয়েও প্রার্থী হিসেবে ‘ব্যক্তি’ বাইরন বড় ফ্যাক্টর ছিলেন।

সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফলঘোষণার পরে তৃণমূল বলেছিল ‘অনৈতিক’ জোটের জন্যই দলের পরাজয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমনই বলেছিলেন। বাংলায় বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএমের মধ্যে ‘লেনদেনের সম্পর্ক’ রয়েছে বলে দাবি করে তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিজেপির ভোট গুনলে দেখা যাবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২২ শতাংশ। এ বার ওরা নিজেদের ১৩ শতাংশ ভোট কংগ্রেসকে হস্তান্তরিত করেছে।’’ নিজের ‘গড়’ মুর্শিদাবাদ থেকে একমাত্র বিধায়ক বিধানসভায় পাঠাতে পেরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘কংগ্রেস প্রার্থী যেমন বামফ্রন্টের ভোট পেয়েছেন, তেমনই বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের বড় অংশের ভোটও পেয়েছেন। বিজেপির ভোটারেরা যাঁরা এই ভোটে তৃণমূলের পরাজয় চেয়েছিলেন, তাঁরাও কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন।’’

ভোটের জোট ছাড়াও শাসকদলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ-সহ নানা কারণ শোনা গিয়েছিল সেই সময়ে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচ্য হয়ে উঠেছিল যে বিষয়টি, তা হল— সংখ্যালঘু ভোট কি তৃণমূলের থেকে সরে যেতে বসেছে? এমন আশঙ্কায় তৃণমূল মুর্শিদাবাদ তো বটেই, অন্য বিভিন্ন জেলাতেও নানা উদ্যোগ নেয়। সাগরদিঘিতে হারের কারণ বিশ্লেষণের কমিটি গড়ার পাশাপাশি মমতা সেই সময়েই দলের সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি পদেও বদল আনেন। কিন্তু পঞ্চায়েতের ফল বলছে, সাগরদিঘি তো বটেই, রাজ্যের অন্যত্রও সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের সঙ্গেই। হয় সাগরদিঘির মূল্যায়ন ভুল ছিল। না হলে মাঝের সময়ে ‘ক্ষত’ মেরামত করতে পেরেছে তৃণমূল।

তবে এ সবকে ‘কারণ’ হিসাবেই দেখছে না কংগ্রেস। মুর্শিদাবাদের নেতা মনোজ চক্রবর্তী বুধবার বলেন, ‘‘এই ফল দিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না। আসলে ভোটই তো হয়নি! মানুষের ভোটে আমরা জিতেছিলাম। এ বার মানুষ ভোট দিতেই পারেনি। ভোটগ্রহণ থেকে গণনা— সবেতেই কারচুপি হয়েছে। তাই এই ফল নিয়ে তৃণমূলের যেমন নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই, তেমনই আমাদেরও হতাশার কারণ নেই। মানুষের রায় জানার জন্য লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের অপেক্ষা করতে হবে।’’

আরও পড়ুন
Advertisement