অনন্ত মহারাজ মানেই রাজবংশী ভোটের অঙ্ক। — ফাইল চিত্র।
‘মহারাজা’ অনন্ত রায়। নিজেকে ‘রাজা’ ঘোষণা করা ছাড়াও কোচবিহারে রাজবাড়ি বানিয়েছেন পৃথক রাজ্যের এই দাবিদার। একটা সময় পর্যন্ত তিনি তৃণমূলের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু এখন আর নয়। গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে অনন্তের সমর্থন পেয়েছে বিজেপি। অনন্ত মানে রাজবংশী ভোট। সেই ভোটে ভাগ বসাতে এক সময়ে যেমন সক্রিয় ছিল তৃণমূল, তেমনই এখন বিজেপি।
অনন্তকেই বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্য হিসাবে রাজ্যসভায় পাঠাতে চায় বিজেপি। মঙ্গলবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটগণনা নিয়ে উত্তাপের মধ্যেই কোচবিহার শহরের রাজবাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক। বিজেপি সূত্রে খবর, সেই সময়ে স্বয়ং অমিত শাহের সঙ্গে অনন্তের কথা হয়েছে। এর পরে তিনি খোলসা করে না জানালেও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বিজেপির তরফে রাজ্যসভায় মনোনয়নের প্রস্তাব পেয়েছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন।
বিজেপি বাংলায় শক্তিশালী হওয়ার পরে এই প্রথম এ রাজ্য থেকে কোনও সাংসদ রাজ্যসভায় পাঠানোর সুযোগ পেয়েছে। রাজ্য বিজেপির নেতারা চেয়েছিলেন, বাংলার সাংগঠনিক দায়িত্বে রয়েছেন, এমন কাউকে পাঠানো হোক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, তাতে শেষ মুহূর্তে খুব বড় কিছু পরিবর্তন না হলে আগামী বৃহস্পতিবার অনন্তের নামই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করবে বিজেপির সংসদীয় বোর্ড। সাংগঠনিক ভাবে বিজেপির সর্বোচ্চ ওই কমিটিতে শাহ তো বটেই, রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডাও। ওই দিনই মনোনয়ন জমা দিতে হবে। বিজেপি সূত্রে খবর, সেই কারণেই অনন্তকে মঙ্গলবার থেকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
কিন্তু অনন্তকে কেন রাজ্যসভায় পাঠাতে চাইবে বিজেপি? দলের একাংশের মতে, এর মাধ্যমে রাজ্য বিজেপিকে মোদী-শাহেরা আরও একটা বার্তা দিয়ে রাখলেন যে, পঞ্চায়েত ভোট-টোট নিয়ে নয়, তাঁদের ভাবনা লোকসভা নির্বাচন। তার জন্য অনন্তের সমর্থন জরুরি। অনন্তের দল ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপল্স অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ) ঘোষিত ভাবে কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র শরিক। সেই হিসাবে বিজেপি যদি অনন্তকে নিজের দলে নিয়ে রাজ্যসভায় সাংসদ করে পাঠায়, তবে আর কার কী বলার থাকবে!
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাবে। যা বিজেপির কাছে ‘অস্বস্তিকর’ হয়ে উঠতে পারে। অনন্ত বা তাঁর দলের মূল দাবি ‘আলাদা রাজ্য’। ‘গ্রেটার কোচবিহার’ নামে বাংলা থেকে বেরিয়ে যাওয়া পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়েই অনন্তদের যাবতীয় আন্দোলন এবং দরকষাকষি। সেই দাবিতে যাতে অনন্ত আর ‘আস্ফালন’ করতে না পারেন, সে জন্যই বিজেপি এই মহারাজকে দলের করে নিতে চাইছে। না কি আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী সমর্থন ধরে রাখতেই এই উদ্যোগ?
বস্তুত, রাজবংশী ভোট শুধু বাংলা নয়, পড়শি অসমের ক্ষেত্রেও জরুরি। অনন্তের ‘প্রভাব’ রয়েছে উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যেও। অনেকগুলি রাষ্ট্রদোহিতার মামলা রয়েছে অনন্তের বিরুদ্ধে। সে জন্য একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চোখে ‘ফেরার’ কোচবিহারের ‘মহারাজা’কে আত্মগোপন করে থাকতে হত অসমে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে অসমে-থাকা অনন্তের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন শাহ। ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলায় আসার আগে নিশীথকে নিয়েই গিয়েছিলেন অনন্তের গোপন ডেরায়। তবে ২০১৯ সালে শিলিগুড়িতে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন অনন্ত। মোদীর সভায় মঞ্চেই ছিলেন মহারাজা। কাওয়াখালির মাঠে বিজেপির পতাকার থেকেও বেশি ছিল জিসিপিএ-র হলুদ পতাকা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও উত্তরবঙ্গে মোদীর সমাবেশ ভরিয়েছিলেন জিসিপিএ সমর্থকরা। সে বারেও মঞ্চে হাজির ছিলেন অনন্ত।
রাজ্য বিজেপির নেতারা বলছেন, দীর্ঘ সময় বিজেপিকে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে সে ভাবে কিছুই পাননি রাজবংশী সমাজের কাছে সম্মানীয় এই নেতা। এ বার তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো হলে বড় বার্তা দেওয়া যাবে রাজবংশী সমাজকেও। বিজেপির রাজনীতিতে এই সম্প্রদায়গত ভাবনার নজির কম নেই। অনেকে বলেন, দলিত পরিচয়ের রামনাথ কোবিন্দ কিংবা আদিবাসী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করার পিছনেও সেই অঙ্কই রয়েছে বিজেপির। বাংলাতেও এর আগে রাজবংশী নিশীথকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করা হয়েছে। আবার মতুয়া মহাসঙ্ঘের শান্তনু ঠাকুরকেও মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে। যার ফল গত বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে। এ বার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়েরই অন্যতম পদক্ষেপ অনন্তকে রাজ্যসভায় পাঠানোর উদ্যোগ। লক্ষ্য, বাংলার সঙ্গে অসমেও ভাল ফল।
অবশ্য অনন্তকে পাশে পেতে তৃণমূলও চায়। গত বছর অনন্তের জন্মদিনে ফুল পাঠিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর তরফে মহারাজের কাছে শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন কোচবিহারের জেলাশাসক পবন কাদিয়ান এবং কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তার আগে ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল কোচবিহারে বীর চিলা রায়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে ছিলেন মমতা ও অনন্ত। আবার গত নভেম্বরেই কোচবিহারে রাসমেলার মঞ্চে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহের পাশে অনন্তকে দেখা যায়। ইদানীং অনন্তের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক কিছুটা ‘শীতল’ হয়েছিল বলে শোনা যায়। কারণ, তাঁর দাবিদাওয়া নিয়ে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও অনন্ত সেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না। সব ভুলিয়ে কাছে টেনে নিতেই কি রাজ্যসভায় মনোনয়নের প্রস্তাব? না কি আরও কিছু?