অনুব্রত মণ্ডলকে নিজের রাজনৈতিক গুরু মানেন কাজল শেখ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বীরভূম আবার তৃণমূলেরই দখলে। শুধু এটুকু বললেই লাল মাটির জেলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বর্ণনা করা যাবে না। কারণ, ২০১৮ সালের সঙ্গে ২০২৩ সালের অনেক ফারাক। রাজ্যের মধ্যে বীরভূমের জন্য সেই ফারাক আবার অনেক বেশি। কারণ, অনুব্রত মণ্ডল ভোটের ময়দানে ছিলেন না। তিনি আপাতত দিল্লির তিহাড় জেলে। তবে বীরভূমের সার্বিক ফলাফলে তার প্রভাব পড়ল না। অনুব্রতের অনুপস্থিতিতে সেই বিপুল জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে রইলেন কাজল শেখ। যাঁকে তৃণমূলের ‘নবজোয়ার’ পর্বের নেতা বলা হচ্ছে।
নিজে বিপুল ভোটে জেলা পরিষদে জিতেছেন কাজল। একই সঙ্গে দলকেও জিতিয়েছেন। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী বীরভূম জেলা পরিষদের ৫২ আসনের মধ্যে ৫১টিতেই জয় নিশ্চিত করে ফেলেছে তৃণমূল। একটিতে জয়ী বিজেপি। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির ফলেও স্পষ্ট— ঘাসফুলের দাপটই রয়েছে বীরভূমে। তবে সর্বত্র বিরোধীদের ‘উপস্থিতি’ও রয়েছে।
২০১৮ সালে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ অনুব্রতের তত্ত্বাবধানে ভোট হয়েছিল। সে বার রাজ্যের অন্যান্য জেলায় যে ভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের নজির তৈরি করেছিল তৃণমূল, তাকে বিরোধীরা ‘বীরভূম মডেল’ নাম দিয়েছিলেন। তার কারণও ছিল। রাজ্যে মনোনয়ন পর্বে হিংসার অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি ছিল ওই জেলায়। ৪২টি জেলা পরিষদ আসনের সবগুলিই বিনা ভোটে জিতেছিল তৃণমূল। পঞ্চায়েতের অন্য দুই স্তরেও দেখা গিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ‘মিছিল’। তার পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের সাতটি আসনে জয় পেয়েছিল তৃণমূল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জেলার দু’টি কেন্দ্রে তৃণমূল জিতলেও ১১টি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি পায় মাত্র একটি আসন। তৃণমূল জেতে বাকি ১০টিতে। তখনও জেলায় দলের হাল ধরেছিলেন অনুব্রত। বলা হত, বীরভূমে কেষ্টর কথায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়।
গত বছর অগস্ট মাসে গরুপাচার মামলায় সিবিআই গ্রেফতার করে অনুব্রতকে। এর পর ইডিও গ্রেফতার করে তাঁকে। গত মার্চ মাস থেকে অনুব্রতের ঠিকানা তিহাড় জেল। সেই সূত্রেই রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল ছিল পঞ্চায়েত ভোটে বীরভূমে তৃণমূলের ফল নিয়ে। উত্তর দিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী জানিয়ে দেন, অনুব্রতই জেলা সভাপতি থাকবেন। জেলায় অনুব্রতের অনুপস্থিতিতে সংগঠন দেখবেন তিনি নিজে। মমতা নিজে জেলার কাজ দেখবেন জানিয়ে দিতেই বীরভূমের নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হয়ে যান। শুধু নিজে দায়িত্ব নেওয়া নয়, একই সঙ্গে জেলার জন্য একটি কোর কমিটিও তৈরি করে দেন মমতা। সেই কমিটিতে জায়গা পান কাজল।
কাজল একা নন, কোর কমিটির আহ্বায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী, মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহও ভোট পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু আলাদা করে নাম উঠে আসে কাজলের। একটা সময়ে জেলার রাজনীতিতে যিনি কেষ্ট-বিরোধী শিবিরের নেতা হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। যদিও কাজল সেটা মানতে চান না। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘ওটা অনেকে বলেন। কিন্তু কারও কাছে কোনও প্রমাণ নেই। কোনও দিন আমার সঙ্গে কেষ্টদার ‘তু তু, ম্যায় ম্যায়’ ছিল কেউ বলতে পারবে না। উনি আমার রাজনৈতিক গুরু। নিজে হাতে রাজনীতিতে এনেছেন। নিজে হাতে সব শিখিয়েছেন। যে জয় বীরভূমে এসেছে তার অংশীদার কেষ্টদাও। তাঁর অনুপস্থিতিতে স্বয়ং দলনেত্রী জেলার কাজ দেখেছেন। তবুও বলব, কেষ্টদা না থেকেও ছিলেন। কারণ, তাঁর দেখানো, শেখানো পথেই আমরা ভোট লড়েছি।’’
এই জয় কি তিনি কেষ্টদাকে উৎসর্গ করতে চান? সতর্ক কাজলের আরও সতর্ক জবাব, ‘‘দলনেত্রী দায়িত্বে ছিলেন। কেষ্টদাও জয়ের অংশীদার। তবে এই জয় উৎসর্গ করব মা-মাটি-মানুষকেই। তাঁদের আশীর্বাদই তো আসল জয়।’’
কখনও কেষ্ট-বিরোধী ছিলেন না বলে কাজল দাবি করলেও জেলার রাজনৈতিক মহল জানে, কতটা ‘মধুর’ ছিল কেষ্ট-কাজল সম্পর্ক। অনেকে বলেন, নিজের একচেটিয়া জনপ্রিয়তা টলে যেতে পারে বলেই ‘শিষ্য’ কাজলকে সে ভাবে সামনে আসতে দিতেন না কেষ্ট। অনুব্রত জেলায় থাকার সময়ে কাজল কখনও নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এই প্রথম সুযোগ পেলেন এবং জিতলেন। কাজল অবশ্য বলছেন, ‘‘আমি আগে নির্বাচনে লড়িনি মানে এটা নয় যে, আমাকে লড়তে দেওয়া হয়নি। আমি নিজেই কখনও জনপ্রতিনিধি হওয়ার কথা ভাবিনি। দলের সৈনিক হিসাবেই কাজ করতে চেয়েছিলাম।’’ এ বার প্রার্থী হলেন কেন? কাজল বলেন, ‘‘আমি চাইনি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে বীরভূমে এসে প্রার্থী বাছাইয়ের ভোট করেছিলেন। তাতেই স্থানীয়েরা আমার নাম দেন। সেই ভোটে জেতায় দল আমায় প্রার্থী করে।’’
কাজলের রাজনৈতিক জীবন ‘ঘটনাবহুল’। অবামপন্থী পরিবারের সন্তান ছোট থেকেই রাজনীতি দেখে এসেছেন। তখন লড়াই ছিল বামেদের বিরুদ্ধে। কাজলেরা সাত ভাই। এক দাদা সীমান্তসুরক্ষা বাহিনীতে চাকরি করতেন। ছুটিতে বাড়িতে এসে ২০০০ সালে বোমার আঘাতে জখম হয়ে মারা যান। সে বার বাবা শেখ সামসুর হকও বোমায় জখম হন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। এক দাদা শেখ হাসানেওয়াজ হক রঘুরও মৃত্যু হয় বাম জমানায় বোমার আঘাতে। এখন জীবিত পাঁচ ভাই। বড় দাদা শেখ শাহনাওয়েজ কেতুগ্রাম বিধানসভার তিন বারের বিধায়ক। আরও দুই ভাই রেলে চাকরি করেন এবং এক ভাই জমিজমা দেখেন। আর কাজল? মাছচাষের ব্যবসা রয়েছে তাঁর। তবে বেশি সময় যায় রাজনীতিতেই। তিনি কোনও রকম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয় দাবি করে কাজল বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সবাই রোজগেরে। মৃত যে দাদা বিএসএফ জওয়ান ছিল, তার পেনশন পান মা। ফলে আমার টাকার দরকার হয় না। রাজনীতি করি সমাজসেবার ভাবনা থেকেই।’’
বয়স খুব বেশি নয়। ৪৯ বছর। কিন্তু বিয়ে করতে পারেননি বাম জমানায়। কাজল বলেন, ‘‘সিপিএম আমার বিরুদ্ধে ৬২টি মিথ্যা মামলা করেছিল। মামলা লড়তে লড়তে যৌবন কেটে গিয়েছে। আমার মাথার দাম ১০ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে লুকিয়ে, পালিয়ে থাকতে হত। পুলিশের তাড়া আর মিথ্যা মামলার জাল থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে বিয়েটাও করতে পেরেছি ৪০ বছর বয়স!’’ স্ত্রী অবশ্য রাজনীতির ধারেকাছে নেই। দুই মেয়ে সামলাতেই দিন চলে যায়। বড়টি পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে আর ছোটটি মাত্র দেড় বছরের।
বাড়িতে বিধায়ক দাদা থাকলেও বরবার তিনি অভিভাবক হিসাবে ‘কেষ্টদা’কেই মেনেছেন বলে জানান কাজল। বলেন, ‘‘কেষ্টদা নেই বলে খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু তার শিক্ষা যে কাজে লাগাতে পেরেছি এটাই সান্ত্বনা।’’ প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত ভোটের পরেই কাজল আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘কেষ্টদা না-থাকলেও তাঁর সাজানো টিমই রয়েছে জেলায়। তাতে কোনও বদল হয়নি। ফলে বীরভূমে তৃণমূল ছিল, আছে, থাকবে।’’ ভোটের প্রচারে কেষ্টর ‘খেলা হবে’ স্লোগানও শুনিয়েছেন। ভোটের পরেও বলছেন, কেষ্টর পথেই খেলেছেন।
তবে একটা ফারাক রয়ে গিয়েছে। সেটাই কেষ্ট জমানার সঙ্গে বর্তমানের ফারাক। এ বার বীরভূমে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮৯০, পঞ্চায়েত সমিতির ১২৭ এবং জেলা পরিষদের একটি মাত্র আসনে ভোটের আগেই জয় পায় তৃণমূল। জেলার মোট ৩,৪০১ আসনের মধ্যে ২,৩৮৩ আসনেই বিরোধী প্রার্থী ছিল। তিন স্তরে জয়ও পেয়েছেন বিরোধীরা।
‘কেষ্টহীন’ বীরভূমে এটাই কি ‘কাজল লাইন’? বোলপুর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তনী কাজলের বক্তব্য, ‘‘আমার একার কিছু নয়। মাথার উপরে রয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার সভাপতি কেষ্টদা। আর এই জেলার সব নেতা-কর্মীর মিলিত লড়াইয়ের ফসল এই জয়। আমার একার কোনও কৃতিত্ব নেই। দল যেমন বলেছে করেছি। যেমন বলবে করব।’’
বীরভূম থেকে অনেক দূরের তিহাড় জেলে বসে অনুব্রত নিশ্চয়ই তাঁর গড়ে জয়ের খবর পেয়েছেন। জেলার নেতারা বলেন ‘একাধিপত্যে’ বিশ্বাস করতেন কেষ্ট। এখন বিরোধী রেখে নিরঙ্কুশ জয়ের স্লোগান তোলা তৃণমূলের নবজোয়ারে খুশি হবেন কি সেই কেষ্ট? ‘ভাই’ কাজলকে দূর থেকে আশীর্বাদ করবেন তো!