তাঁর সরকারের স্লোগান ছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নভঙ্গও সমান ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন জীবদ্দশায়। হয়তো স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের দোলাচলে ভগ্ন হৃদয়, ভগ্ন মন নিয়েই বিদায় নিলেন তিনি। তিনি— বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ব্যক্তিগত সততার নিরিখে এক বিরল রাজনীতিক। ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কোলাপুরি চপ্পলে আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক। পশ্চিমবঙ্গের ১১ বছরের মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম উত্তর কলকাতায়। ১ মার্চ, ১৯৪৪। পূর্বপুরুষের আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশ। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে পাশ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র কিন্তু গোড়া থেকে ছাত্র রাজনীতির মূলস্রোতে ততটা সম্পৃক্ত ছিলেন না। কবাডি খেলতেন। খেলতেন ক্রিকেটও। চোখের সমস্যার জন্য তাঁকে ক্রিকেট খেলা ছাড়তে হয়। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে রোম্যান্টিসিজ়ম তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্যের অন্যতম কারণ ছিল ক্রিকেট। সেটি ক্রিকেট রোম্যান্টিক বুদ্ধদেব। আর যে বুদ্ধদেব বঙ্গ ক্রিকেটকে ‘অশুভ শক্তি’র হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়ে কার্যত প্রকাশ্যেই সিএবি-র নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন অধুনাপ্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে, তিনি পরিচ্ছন্ন প্রশাসন-প্রয়াসী।
বামপন্থী পরিবারে বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি বুদ্ধদেবের উপর প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) ভেঙে সিপিএম বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তৈরি হয়। এর দু’বছর পর ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। তার আগে পর্যন্ত তিনি বাম-মনস্ক একজন ছাত্র ছিলেন, সাহিত্যের নানা ধারায় যাঁর বিচরণ। দলে যোগ দেওয়ার পরও মূলত দলীয় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা এবং লেখালিখির দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রশ্নে যখন বাম ছাত্র রাজনীতিতে বড় ভাঙন দেখা দিচ্ছে, শৈবাল মিত্র-আজিজুল হকের মতো নেতারা যখন পা বাড়াচ্ছেন ভিন্ন দিকে, তখনই বুদ্ধদেবের উত্থান। যুব আন্দোলনের প্রাথমিক সংগঠক হিসেবে যাত্রা শুরু তাঁর। সিপিএমের যুব সংগঠনটির তখন সূচনা লগ্ন।
ষাটের দশকের শেষের দিকে প্রাদেশিক গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফ)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন বুদ্ধদেব। খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। সত্তরের দশকে মূলত কলকাতা জেলা জুড়েই তিনি সংগঠন শক্তিশালী করার কাজে ব্রতী হন। দলের প্রয়োজনে গ্রামবাংলায় বক্তৃতা করতে গেলেও সে সময় তাঁর কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছিল শহর কলকাতা জুড়ে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বৃত্তে যাতায়াতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি।
বুদ্ধদেব সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন সত্তরের দশকের গোড়ায়। ১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে জেতেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। এটি পরে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর নামে পরিচিত হয়। ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হন বুদ্ধদেব। পরে ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। সেই থেকেই তাঁর কেন্দ্র যাদবপুর। যে কেন্দ্র ২০১১ সালে তাঁকে বিমুখ করেছিল। তখন রাজ্যে পালাবদলের পালা।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বুদ্ধদেব। শোনা যায়, তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি সচিবের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল তাঁর। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সচিবের পক্ষ নেওয়ায় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব মন্ত্রিসভা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। শোনা গিয়েছিল, তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না।’’ কিন্তু তার কোনও সমর্থন কোনও তরফেই মেলেনি। বুদ্ধদেবের মন্ত্রিত্ব-ত্যাগ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি আবার মন্ত্রিসভায় ফিরে যান। ওই ঘটনাপ্রবাহের কাছাকাছি সময়ে তিনি একটি নাটক লিখেছিলেন ‘সময়, অসময়, দুঃসময়’। সেটি নিয়েও কম চর্চা হয়নি। অনেকেই চেয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে নাটকটির শিরোনামকে মিলিয়ে দিতে। কিন্তু নাটকের বিষয় একেবারেই তা ছিল না।
তথ্য সংস্কৃতির পাশাপাশি বুদ্ধদেব স্বরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরেরও দায়িত্ব সামলেছেন জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায়। প্রশাসনের তরফে তিনিই পুলিশ দফতর পরিচালনা করতেন। ১৯৮৪ সাল থেকে বুদ্ধদেব সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য। ১৯৮৫ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে জ্যোতি বসুর সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন। পলিটব্যুরোর সদস্য হন ২০০০ সালে। সে বছরই ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন জ্যোতিবাবু অবসর নেওয়ার পর। ২০১১ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।
২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পালে হাওয়া’ ছিল বলে অনেকেই মনে করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। পরের বার, অর্থাৎ ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪-এর মধ্যে ২৩৫টি আসনে জেতে বামফ্রন্ট। ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শিল্পায়নের অভিমুখে রাজ্যকে এনে ফেলতে সে দিনই তিনি সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর এক লক্ষ টাকার গাড়ি কারখানার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যে সিঙ্গুরে জমি পরিদর্শনে গিয়ে গ্রামবাসীদের বিরোধিতার মুখে পড়েন টাটার প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে বিধানসভায় তৃণমূল সরব হওয়ায় সেই সময়ে বুদ্ধবাবুর ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০! কী করবে ওরা’ মন্তব্য নিয়ে কম শোরগোল হয়নি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা হয়নি। মমতা-সহ বিরোধীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে রতন টাটা সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করেন।
রাজ্যকে শিল্পায়নের সরণিতে দ্রুত এনে ফেলতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু সিঙ্গুরে এবং নন্দীগ্রামে ‘জোর করে’ কৃষিজমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা চরমে উঠেছিল। সেই সময় তাঁর সরকারের স্লোগান ছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’।
২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলি চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহত হন ১৪ জন গ্রামবাসী। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই বিতর্ক তাড়া করতে শুরু করেছিল বুদ্ধদেবকে। কোথাও কোথাও প্রশাসনিক রাশ আলগা হওয়াও চোখে পড়ছিল। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে একতরফা ফলের দু’বছরের মধ্যে, ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে খানিকটা ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ দখল করে বিরোধী তৃণমূল। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়ায় বামফ্রন্ট জিতলেও তৃণমূল ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
ধাক্কা আরও বৃহদাকার ধারণ করে ২০০৯ লোকসভা ভোটে। ৪২টি আসনের মধ্যে ২৭টিতে হেরে যায় বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। ১৯টি আসন জেতে বিরোধী তৃণমূল। তাদের সমর্থনে আরও একটি আসনে জেতে এসইউসি। তখন থেকেই রাজ্যের পরিস্থিতির উপর রাশ হারাতে শুরু করে বুদ্ধদেবের প্রশাসন। তাঁর দলের নিচুতলার কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় দলবদলের হিড়িক।
বামফ্রন্টের রক্তক্ষরণ অব্যাহত ছিল। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য রাজনীতিতে বড় পটপরিবর্তন ঘটে। বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে হারিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। অবসান হয় দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের। রাজভবনে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন বুদ্ধদেব। সুভদ্র রাজনীতিক সেই আমন্ত্রণ ফেরাননি।
ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর সিপিএমের অন্দরে দলিল পেশ করে বুদ্ধদেব বলেন, শিল্পায়নের পথে এগোনোর জন্য তাঁর সরকারের নীতি ছিল সঠিক। শিল্পের জন্য জমি নেওয়াও ছিল সময়ের দাবি। তাঁর বক্তব্য ছিল, এই অনিবার্য প্রক্রিয়ার মাঝে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ‘ব্যতিক্রম’। দুই ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল। ব্যতিক্রম থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি। ব্যতিক্রমের জন্য শিল্পায়নের পথ থেকে সরা যায় না বলেই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
নন্দীগ্রামে গুলিচালনায় গ্রামবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা বুদ্ধদেবের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, ওই ঘটনার জন্য তিনিই ‘দায়ী’। ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন বুদ্ধদেব।
বুদ্ধদেবের পেশ করা এক দলিলে ‘জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে’ এবং ‘সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে ব্যতিক্রম’ শীর্ষক দু’টি অধ্যায় ছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘‘নতুন শিল্পের জন্য জমি প্রয়োজন। আমাদের রাজ্যে অকৃষি খালি জমি পাওয়া দুষ্কর। পরিকল্পনা করে এই জমিগুলি নির্দিষ্ট করতে হয়।’’ তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সরকারি পরিকল্পনা যতই বাস্তবসম্মত হোক, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে পরিকাঠামো ও শিল্পের জমি ব্যবহারে দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে।’’
কিন্তু তাঁর শিল্পায়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে সায় দেয়নি রাজ্যের মানুষ। জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মমতা নিজের রাজনৈতিক জমি তৈরি করছিলেন দুর্বার বেগে। নিজের মধ্যে পরিবর্তন এবং দলের ভিতরে পরিবর্তন আনতে চেয়ে খানিকটা একলা হয়ে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব। দলের শ্রমিক ইউনিয়ন সিটুর জঙ্গি ভূমিকার বদল, বন্ধ-অবরোধের রাজনীতি থেকে সরে আসা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দলেরই একাংশের তোপে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দলের প্রবীণতম নেতা জ্যোতি বসুর কাছে অনুযোগও যেতে শুরু করেছিল নিয়মিত ভাবে।
২০১১-র নির্বাচনে হারের পর থেকেই বুদ্ধদেবের শরীর ভাঙতে শুরু করে। দলীয় কাজকর্ম থেকেও ক্রমশ অব্যাহতি নিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও দু’বেলা আলিমুদ্দিনের দলীয় দফতরে আসতেন মূলত পড়াশোনা করার জন্য। ধীরে ধীরে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। শ্বাসকষ্টের পুরনো সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বাড়িতেও চলে পর্যবেক্ষণ। সিওপিডি-র সমস্যার জন্য ২০১০ সাল থেকে বিমানে উঠতে পারতেন না। দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকার সময়ে সেই কারণেই বাইরের রাজ্যে বৈঠকে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বুদ্ধদেবের। অক্সিজেন সিলিন্ডার তাঁর সর্ব ক্ষণের সঙ্গী হয়ে পড়েছিল। শেষ বার তাঁকে জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে। কিন্তু ধুলোবালির প্রকোপে গাড়ি থেকেও নামতে পারেননি।
ক্রমশই শরীর ভাঙছিল তাঁর। পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট দু’কামরার সরকারি ফ্ল্যাটই তাঁর বরাবরের নিবাস হয়ে থেকেছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও সেই ঠিকানা ছাড়তে চাননি। ঘনিষ্ঠেরা জোর করেছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনুরোধ করেছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব রাজি হননি।
শেষের দিকে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণতর হয়ে এসেছিল বুদ্ধদেবের। পড়াশোনা করতে পারতেন না। দৃষ্টিশক্তি প্রায় চলে যাওয়ার কারণে শেষ বইটি নিজে হাতে লিখতেও পারেননি। তাঁর বলা কথা শুনে শুনে বইটি লেখা হয়েছিল।
সাহিত্যপ্রেমী বুদ্ধদেব বহু নাটক, প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশি কবি-লেখকদের লেখা অনুবাদও করেছেন। তাঁর লেখা বই ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’য় সমালোচনা করেছিলেন বর্তমান চিনের নীতিরও। আশির দশকের শুরুতে প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে চিনে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। বইয়ের উপসংহারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। দেশ-বিদেশের একাধিক প্রথম সারির সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ছিল বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গেও।
২০২২ সালে বুদ্ধবাবুকে পদ্মভূষণ সম্মানের জন্য মনোনীত করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রশাসক বুদ্ধদেবকে নিয়ে নানা বিতর্ক সত্ত্বেও শুধু বাম কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই নয়, বুদ্ধদেবের জনপ্রিয়তা আমজনতাকেও ছুঁয়ে গিয়েছে বারংবার। তাঁর সোজাসাপটা জীবন, পাম অ্যাভিনিয়ের সাধারণ ফ্ল্যাটের যাপন এসেছে চর্চার কেন্দ্রে।
হতে পারে, বঙ্গ রাজনীতিতে যখন বামশাসনের অবসান ঘটেছিল, তখন বুদ্ধদেবই ছিলেন নেতৃত্বে। সে অর্থে, সেই দ্রোহকালে তিনিই ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু তা ছাড়াও রাজ্যের রাজনীতিতে বহু ক্রান্তিলগ্নের নায়ক হিসেবে থেকে যাবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।