ওঁর দলের কেউ অন্যায় করলে সহজে জানাতে পারতাম। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সে দিন প্রথম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়। সম্ভবত ১৯৮৮ সাল। আমি তখন কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের ডেপুটি কমিশনার। সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ এলাকায় অনেক বিয়েবাড়ি ছিল। এখনও আছে। ওখানে বিয়ের মরসুম এলেই গাড়ির ভিড় হয়। সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে কখনও কখনও নিজেই ওসিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। তেমনই এক দিন সেখান দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বুদ্ধবাবু। তার আগে কোনও দিন ওঁর সঙ্গে কথা হয়নি। আমাকে বিয়েবাড়ির সামনে গাড়ি সরাতে দেখে হয়তো ভেবেছিলেন, মানুষের সমস্যার কথা না ভেবে অতিথিদের সাহায্য করতে নেমে পড়েছি! বুদ্ধবাবুর গাড়ি থামল একটা বিয়েবাড়ির সামনে। তিনি কাচ নামিয়ে আমাকে ডেকে বললেন, “কাল আমার সঙ্গে এক বার দেখা করবেন।” বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন তিনি।
ওঁর সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাৎ। তা-ও বিয়েবাড়ির সামনে। যথারীতি পর দিনই মহাকরণে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলেন, “কী করছিলেন ওখানে? সাধারণ মানুষের অসুবিধা হচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না? আপনি বিয়েবাড়ির গাড়ি সরাচ্ছেন।” তত ক্ষণে বুঝে গিয়েছি, যা ভাবছিলাম ঠিক তাই। উনি আমাকে ভুলই বুঝেছেন। ওঁকে বুঝিয়ে বললাম, “বিয়েবাড়ির জন্য সাধারণ মানুষের অসুবিধা হচ্ছিল। সে কারণেই গিয়েছিলাম।” সব শুনে ঘাড় নেড়ে বললেন, “আচ্ছা। তা হলে ঠিকই করেছেন। বিয়েবাড়ি হচ্ছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সাধারণ মানুষের অসুবিধা হবে। যেমন দেখছেন, দেখবেন।”
মহাকরণে পরিচয় পর্বেই বুঝে গিয়েছিলাম উনি মানুষের সমস্যাকে কতটা গুরুত্ব দেন। এর পর নানা সময়ে দেখেছি, মানুষের খারাপ-ভাল নিয়ে ভাবছেন। কী করতে হবে নির্দেশ দিচ্ছেন। ওঁর নির্দেশেই কলকাতার ট্র্যাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উপর জোর দিতে শুরু করি। খোঁজখবর নিতেন। তবে সে ভাবে রোজ কথা হত না। এরই মধ্যে সেন্ট্রাল ডেপুটেশনে সিবিআইতে যোগ দেওয়ার সুযোগ এল। বুদ্ধবাবু মহাকরণে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, “কোনও অসুবিধা হচ্ছে? কেন চলে যাচ্ছেন?” ওঁর মুখের অভিব্যক্তি এখনও ভুলতে পারিনি। বলেছিলাম, “আইপিএস অফিসার হিসাবে এক বার সেন্ট্রালে কাজ করা উচিত বলে মনে করি।” উনি কিন্তু আমায় বাধা দেননি। বরং অনুপ্রেরণাই জুগিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে সেটা ছিল দ্বিতীয় বার মুখোমুখি সাক্ষাৎ। তার পর যোগাযোগ কমই ছিল। ১৯৯২ সালে রাজ্যে ফিরে এলাম কলকাতা পুলিশের ডিসি-ডিডি হয়ে। কোনও বড় ঘটনা হলে খোঁজ নিতেন। নানা বিষয়ে জানতেও চাইতেন। কিন্তু তদন্তে কোনও দিন প্রভাব খাটাতে দেখিনি। দরকার পড়লে বুঝিয়ে বলতেন, ‘আপনি এ ভাবে দেখতে পারেন’ বা ‘ওটা করা কি ঠিক’ ইত্যাদি। নানা পরামর্শও দিতেন। কিন্তু কোনও দিন বলেননি— একে ধরুন, ওকে ধরুন!’’
ডিসিডিডি-র পর আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) হলাম। জেলা সফরে আসতেন বুদ্ধবাবু। তখন তো দেখা হতই। প্রশাসনিক বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনাও হত। বুদ্ধবাবু আমাদের কাছে জানতে চাইতেন, ঘটনার পিছনে কাদের হাত আছে। ওঁর দলের কেউ আছেন জানতে পারলেও আড়াল করতেন না। উল্টে বলতেন, ‘‘ছেড়ে দেবেন না!’’ তখন তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ওই ভাবে স্পষ্ট বার্তা দিতে খুব কম প্রশাসনিক প্রধানকে দেখেছি। ফলে আমাদের কাজ করারও সুবিধা হত। স্বাধীনতা ছিল। ওঁর দলের কেউ অন্যায় করলে সহজে জানাতে পারতাম। আমাকে ভালবাসতেন। আমাদের মধ্যে সুসম্পর্কও ছিল, এটা বলতে কোনও বাধা নেই। তবে অন্যায়কে কোনও দিন প্রশ্রয় দিতেন না। প্রশাসনে থাকলে নানা রকম কথা কানে আসে। আমার বিরুদ্ধেও একাধিক অভিযোগ এসেছিল। সমস্ত খতিয়ে দেখেছিলেন বুদ্ধবাবু। পরে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব আমাকে জানান। কেউ ভুল করলে তিনি ছেড়ে দিতেন না। আমাকেও না।
আমি কলকাতা পুলিশের কমিশনার। ২০০৭ সাল। ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় একটি ঘটনা ঘটেছিল (রিজওয়ানুর রহমানের অপমৃত্যু)। প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বদলে আমাকে আনা হল। অনেক বড় দায়িত্ব। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেই সাক্ষাৎটা কোনও দিন ভুলব না। উনি একটা ছোট্ট ‘ব্রিফিং’ দিলেন— ‘‘যা নির্দেশ দেওয়ার আমি ছাড়া মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব দেবেন। আর কারও নির্দেশ শোনার প্রয়োজন নেই। দলের কেউ বললেও নয়।’’ প্রশাসক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওই একটি ‘ব্রিফিং’ আমার মনের জোর কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পর এক দিনের জন্যেও অন্য কারও নির্দেশে কাজ করতে হয়নি। শুধু আমি একা নই। অন্যেরাও নিজেদের মতপ্রকাশ করতে পারতেন। এটা পুলিশ এবং প্রশাসনিক অফিসারদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এমনও হয়েছে, কোনও পদের জন্য বিশেষ কাউকে ভাবছেন। আমরা মনে করলাম, সেটা ঠিক হবে না। উনি আমাদের কথায় গুরুত্ব দিতেন। অনেক ভাবনাচিন্তার পর নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতেও দেখেছি। মনে আছে, ওঁর দলেরই একজন পুলিশের কাজে বাধা দিচ্ছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, কী করা উচিত? বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমি দেখছি।’’ তার পর ওই নেতা আর কোনও দিন কিছু বলতে আসেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। থাকতে পারে না। পার্টির সঙ্গে প্রশাসনকে কখনও গুলিয়ে ফেলেননি বুদ্ধবাবু। তাঁর সময়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারত পুলিশ।
তখন নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। নন্দনে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। সেখানে জোর করে ঢুকতে চাইছিলেন আন্দোলনকারীরা। ছিলেন নামী, গুণী বহু মানুষ। একপ্রকার বাধ্য হয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ, অভিনেত্রী অপর্ণা সেনদের গ্রেফতার করে লালবাজারে আনা হল। বুদ্ধবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘‘ওঁদের কাছে গিয়ে বলুন, আপনি দুঃখিত।” আমি অবাক! দুঃখিত কেন? ওঁকে উল্টে বলি, আমরা তো কোনও অন্যায় করেননি। তা হলে দুঃখিত কেন? তবে ওঁর নির্দেশ মতো শঙ্খবাবুকে বুঝিয়ে বললাম, চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। সেটা বানচাল করতে দেওয়া যায় না। আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়নি। ওঁরাও বিষয়টি মিটিয়ে নিলেন। এ ভাবেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতেন বুদ্ধবাবু। এমন উদাহরণ পরবর্তী সময়েও পেয়েছি। সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার চত্বর। বাসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। বেশির ভাগই অল্পবয়সি ছেলে। পুলিশকে ঢিল মারছে। তখনও উনি বলেছিলেন, ‘‘গুলি যেন না চলে!’’ এতটাই ঠান্ডা মাথায় প্রশাসন সামলাতেন বুদ্ধবাবু।
পুলিশকে দিয়ে বিরোধী কণ্ঠকে জোর করে দমিয়ে রাখার কোনও চেষ্টা করতেন না। মনে পড়ছে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী নেত্রী। পাম অ্যাভিনিউয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন। কিন্তু তখনও বুদ্ধবাবু জোর করে বিক্ষোভকারীদের তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেননি। পরে এমন অনেক ঘটনা ঘটতে দেখেছি। কিন্তু বিরোধী দলকে কিছু করতে দেওয়া হবে না— এমন নির্দেশ কখনও আসেনি। অন্তত আমার কাছে তো আসেনি।
২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় আইইডি বিস্ফোরণ হচ্ছে। বুদ্ধবাবু আমাদের ডেকেছেন। জানতে চাইলেন, ‘‘আপনারা কী ভাবছেন? বিস্ফোরণ হচ্ছে! আমরা তৈরি তো?’’ নানা আলোচনার পর ওঁর উদ্যোগেই স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) তৈরি হয়েছিল। ‘ওয়াচ টাওয়ার’ থেকে নজরদারির বিষয়টি ওঁর মাথাতেই প্রথম এসেছিল। আবার পুলিশ-জনতা যোগাযোগ বাড়াতে বুদ্ধবাবুর পরামর্শেই পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছিল। পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলাও শুরু হয়েছিল পুলিশের উদ্যোগে। গ্রিন পুলিশ ভলান্টিয়ার বুদ্ধবাবুরই চিন্তাভাবনার ফসল।
২০১১ সালে নতুন সরকার গঠন হওয়ার পর আর বুদ্ধবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। ফোনেও কথা হয়নি। পরে ওঁকে এক বার দেখেছিলাম উডল্যান্ডস হাসপাতালে। সেই শেষ দেখা।
(লেখক কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার)