Buddhadeb Bhattacharjee Passes Away

এমন ব্যক্তিত্ব এখনকার রাজনীতিকদের কাছে আদর্শ হতেই পারেন

১৯৯৬ সাল। নবগ্রাম কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথম বার বিধানসভায় গিয়েছি। আমি তখন অনেক ছোটও। বিধানসভাতেই প্রথম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ।

Advertisement
অধীর চৌধুরী
অধীর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ১০:৪২
Adhir Ranjan Chowdhury remembers former West Bengal Chief Minister

মতাদর্শ আলাদা হলেও কুৎসা করতে কখনও বুদ্ধবাবুকে শুনিনি। ২০১১ সালে যাদবপুরে নির্বাচনী প্রচারে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

নয় নয় করে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। ১৯৯৬ সাল। নবগ্রাম থেকে জিতে প্রথম বার বিধানসভায় গিয়েছি। আমি তখন অনেক ছোটও। সেখানেই প্রথম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ। তখন বামেদের রমরমা জমানা। তৃণমূলের জন্মও হয়নি। রাজ্যে আমরা, কংগ্রেসিরাই প্রধান প্রতিপক্ষ। ফলে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তুমুল রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। কিন্তু সেই বিরোধিতার জায়গা থেকে এখনও পর্যন্ত কখনও ব্যক্তিগত মনোমালিন্য হয়নি। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। কিন্তু কোনও বারই সৌজন্যের বিন্দুমাত্র খামতি দেখিনি। কোনও ঔদ্ধত্যও চোখে পড়েনি। বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন তিনি।

Advertisement

১৯৯৯-এর লোকসভা ভোটে বহরমপুর থেকে দাঁড়ালাম। বাম জমানাতেও মুর্শিদাবাদ জেলা কিন্তু কংগ্রেসের ‘গড়’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই ভোটে জিতলাম। পৌঁছলাম সংসদে। অনেক চেষ্টা করেও বহরমপুর সে বার নিজেদের দখলে না নিতে পেরে একের পর এক কংগ্রেস কর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। বুদ্ধবাবু তখন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী। ২০০০-এর নভেম্বরে তিনিই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন। পুলিশমন্ত্রীরও। আমাদের মধ্যে তখন কার্যত সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বামেদের ওই চাপের মুখেও কিন্তু কংগ্রেস কর্মীরা আমার জেলায় দলত্যাগ করে সিপিএমে যোগ দেননি। তখন কিন্তু এখনকার মতো রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল না। ওই পরিস্থিতিতে দলীয় মতাদর্শ আলাদা হলেও বুদ্ধবাবুকে কখনও ব্যক্তিগত কুৎসা করতে শুনিনি। রাজনীতির স্বার্থে আমাদের অনেক কথা বলতে হয়। উনিও বলেছেন। আমিও বলেছি। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনও তার প্রভাব পড়েনি।

২০১৬ সাল। বিধানসভা ভোটের প্রচারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রাহুল গাঁধীর সঙ্গে মঞ্চে লেখক (একেবারে বাঁ দিকে)।

২০১৬ সাল। বিধানসভা ভোটের প্রচারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রাহুল গাঁধীর সঙ্গে মঞ্চে লেখক (একেবারে বাঁ দিকে)। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

বুদ্ধবাবুর আমলেই কংগ্রেসের ‘গড়’ ভাঙার চেষ্টা করে সিপিএম। বহরমপুরে জোড়া খুন-সহ একাধিক মামলায় আমাকে ফাঁসানো হয়। দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হয় আমাকে। সত্যি কথা বলতে কী, তখন কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বুদ্ধবাবুর সঙ্গে। ওঁর উপর খুব রাগও হয়েছিল। কিন্তু সেটা ধরে কেউই বসে থাকিনি। প্রতিহিংসাপরায়ণও হয়ে উঠিনি। ওই ঘটনা নিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যে কখনও কোনও কথাও হয়নি। মনোমালিন্যও হয়নি।

বুদ্ধবাবু মানুষটাই আসলে অন্য রকম ছিলেন।

২০১১ সালে রাজ্যে বাম জমানার অবসান হয়ে গেল। রাজপাটের শেষের দিকেও ওঁকে চাপের কাছে কোনও রকমের নতিস্বীকার করতে দেখিনি। সে বার বামেদের সরিয়ে মহাকরণের দখল নিল তৃণমূল। পরের ভোট, অর্থাৎ ২০১৬-র বিধানসভার আগে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট হল। সেই ভোটের প্রচারে এসেছিলেন রাহুল গান্ধী। পার্ক সার্কাস ময়দানে সভা। মঞ্চে বুদ্ধবাবু ছিলেন। তখনও ওঁর শরীরটা এত ভাঙেনি। তবে অসুস্থ ছিলেন। দলের স্বার্থেই সভায় এসেছিলেন। আমিও ছিলাম। ওই সভায় আমি সে দিন বলেছিলাম, ‘‘ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকল বাংলা।’’ আর বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘এই সমাবেশে লাল ঝান্ডা উড়ছে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের নেতারা এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি ও রাহুল গান্ধী এক মঞ্চে। কেন? আমরা বুঝতে পারছি, এ বাংলার এখন ভয়ঙ্কর বিপদ।’’ ঐতিহাসিক তো বটেই। দিনটার কথা এখনও মনে আছে।

বুদ্ধবাবু আদ্যোপান্ত দলের মানুষ ছিলেন। সারা জীবন দলের জন্য কাজ করে গেলেন। এখন রাজনীতিকদের মধ্যে আদর্শ খুব কম দেখা যায়। স্বার্থ চরিতার্থ করতে দলবদল এখন খুব সহজ কাজ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে শেষ দিন পর্যন্ত নিজের নীতি, আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হওয়া এমন একটা মানুষ বর্তমান রাজনীতিকদের কাছে আদর্শ হতে পারেন।

(লেখক প্রাক্তন সাংসদ তথা কংগ্রেস নেতা )

আরও পড়ুন
Advertisement