Buddhadeb Bhattacharjee Passes Away

পেশাগত জীবনে যা-ই ঘটুক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আটকে যায়নি

আমার সিএবি-র ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। বু্দ্ধদেব ভট্টাচার্য নাকি আমায় জোর করে সিএবি-তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়েছিলেন! এটা সত্যি নয়।

Advertisement
প্রসূন মুখোপাধ্যায়
প্রসূন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ১০:৫৮
Buddhadeb Bhattacharjee remembered by Ex Police Commissioner of Prasun Mukherjee

রিজওয়ানুরের ঘটনায় কাউকে আড়াল করে বাঁচানো হয়নি। ঘটনাটা যখন প্রকাশ্যে আসে, আমি তখন মুম্বইয়ে। আর বুদ্ধবাবুও কিছু জানতেন না। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

আমি তখন ডিসি নর্থ। তখন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমায় চিনতেন। উনি তখন কাশীপুরের বিধায়ক। ভোটের সময় ঝামেলা হয়েছিল। আমি নিরপেক্ষ ভাবেই ভোট করিয়েছিলাম। কোন দলকেই ‘বাড়তি সুবিধা’ দিইনি। তখন সিপিএম আমল। ফলে আমার খুব বদনামও হল। এক নেতা আমায় বললেন, ‘‘একটু তো ছাড় দিতে পারতেন। বুদ্ধবাবু হেরে গেলেন। এ বার আপনি শেষ হয়ে যাবেন।’’

Advertisement

নির্বাচনের মাসখানেক পর ওঁর সঙ্গে দেখা। মন থেকে না চাইলেও, তখন কেন জানি না ‘সরি’ বলেছিলাম। তার পর যা ঘটল, অবাক হওয়ার মতো। উনি আমাকে বললেন, “আপনি আপনার কাজ করেছেন। আমরা আমাদের কাজ করেছি। আমাদের ‘মেশিনারি’ ওদের ‘মেশিনারির’ কাছে হেরে গিয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু নয়।”

আমার কিন্তু বদলি হয়নি। বরং বুদ্ধবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছিল। উনি মানুষটাই এমন ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে এক কথায় বলতে গেলে, এক জন সৎ এবং স্বচ্ছ মানুষ। কী করতে হবে, আর কী করতে হবে না, ভাল বুঝতেন। পরবর্তী সময়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, প্রতিটা বিষয়েই ওঁর স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। কিন্তু তার পরেও কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনতেন। আর পুলিশের দৈনন্দিন কাজে কখনও হস্তক্ষেপ করতেন না। কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে সরকারের নির্দিষ্ট কোনও পলিসি থাকলে আগে থেকে বলে দিতেন। এটুকুই। আর যত বড়ই ঘটনা হোক না কেন, আমাদের আগে থেকেই বারণ করতেন গুলি চালাতে। বলতেন, ‘‘দেখবেন, যেন গুলি না চলে!’’

Buddhadeb Bhattacharjee remembered by Ex Police Commissioner of Prasun Mukherjee

সিএবি নির্বাচনে আমাকে ওঁর তরফে কোনও সাহায্য করা হয়নি। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

আরও একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। তখন আমি কলকাতার পুলিশ কমিশনার। এক মাসের মাথায় এক জন অফিসারকে বদলি করেছিলাম। তার পর মহাকরণে গিয়ে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে দেখা করি। জানতে চাই, ওসিদের বদলির বিষয়েও কি আপনার মতামত নিতে হবে? উনি বলেছিলেন, ‘‘ওসি নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার নেই। আপনার উপর দায়িত্ব দিয়েছি। আপনি ঠিক করবেন। আপনাকে কমিশনার করেছি। যদি দেখি কাজ হচ্ছে না, আপনাকেই পাল্টে দেব!” এমনই ছিল ওঁর ব্যক্তিত্ব আর চিন্তাভাবনা।

ওঁর সময়ে যাঁরা আমরা পুলিশে কাজ করেছি, সকলেই জানি পার্টি আর প্রশাসনকে উনি আলাদা চোখেই দেখতেন। এমনকি, পার্টি ধর্মঘট ডাকলেও উনি তার বিরোধিতা করতেন। এমনও হয়েছে, সিটু একবার ধর্মঘট ডেকেছে। কিন্তু উনি অফিসে হাজির। দল ধর্মঘট ডেকেছে বলে বাড়িতে থাকতে হবে, এমনটা উনি কখনও ভাবতেন না। রাজ্যের উন্নয়ন নিয়েই বেশি ভাবতেন। কর্মসংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। অনেক ধৈর্যও ছিল। মাঝেমধ্যে অবশ্য উত্তেজিত হয়ে পড়তেন কথা বলতে বলতে। কিন্তু সেটা ওঁর কথা বলার ধরন ছিল। কাউকে ছোট করার মানসিকতা কোনও দিন ছিল না।

আমার সিএবি-র ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। বু্দ্ধদেব ভট্টাচার্য নাকি আমায় জোর করে সিএবি-তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়েছিলেন! এটা সত্যি নয়। এক বার উনি আমার সিএবি-তে দাঁড়ানো নিয়ে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন ঠিকই। যে হেতু আমি মাঠের লোক। খেলাধুলো ভালবাসতাম। তাই। কিন্তু সিএবি নির্বাচনে সরকারের তরফে কোনও সাহায্য করেননি। আমি নিজেই মনে করেছিলাম। তাই সিএবি-র ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম। হারব না জিতব ভাবিনি। নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়েও কোনও আলোচনা করেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই সময়ে আমি যখনই ওঁর সঙ্গে দেখা করতাম, কলকাতার পুলিশ কমিশনার হিসাবেই কথা বলতাম। সিএবি নিয়ে কখনও কোনও আলোচনা হত না। কিন্তু সেটা নিয়ে মানুষের অনেক ভুল ধারণা রয়ে গিয়েছে এখনও। আমাকে ওঁর তরফে কোনও সাহায্য করা হয়নি।

Buddhadeb Bhattacharjee remembered by Ex Police Commissioner of Prasun Mukherjee

উনি দক্ষ প্রশাসক। ভাল মানুষ ছিলেন। পুলিশকে কাজ করতে দিতেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

আর একটা বিষয় বলতেই হবে। রিজওয়ানুর রহমান নিয়েও অনেক রটনা রয়েছে। পুলিশ কিন্তু নিরপেক্ষ ভাবেই তদন্ত করেছিল। কিন্তু ওটা পরে ‘পলিটিক্যাল অ্যাজিটেশন’ হয়ে গিয়েছিল। রিজওয়ানুরের ঘটনা একটা ‘ইনসিডেন্ট’ মাত্র। কাউকে বাঁচানো হয়নি। তবে উনি বিষয়টি ‘পলিটিক্যালি’ সামলাতে পারেননি। আমাকে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে বদলি করা হতে পারে।’’ আমি বলেছিলাম, ‘‘আপনি যদি তা-ই মনে করেন, করবেন। আমার কোনও আপত্তি নেই।’’ তার পরে আমি বদলিও হয়ে যাই। কিন্তু আমি ওঁকে এ-ও বলেছিলাম, ‘‘আপনার যদি পলিটিক্যালি ভাল হয়, তা হলে বদলি করুন।’’ তার পর আমি দিল্লি চলে গেলাম।

রিজওয়ানুরের ঘটনায় কাউকে আড়াল করে বাঁচানো হয়নি। ঘটনাটা যখন প্রকাশ্যে আসে, আমি তখন মুম্বইয়ে। আর বুদ্ধবাবুও কিছু জানতেন না।

বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন তিনি।

আবার বলছি, উনি দক্ষ প্রশাসক। ভাল মানুষ ছিলেন। পুলিশকে কাজ করতে দিতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমার কাছে দাদার মতোই ছিলেন। পেশাগত জগতে যা-ই ঘটুক না কেন, কখনও ওঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আটকে যায়নি।

(লেখক কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার)

আরও পড়ুন
Advertisement