গোরক্ষপুর (শহর) আসনে যোগী ড্যাং-ড্যাং করে জিতবেন, এটা তাঁর গোশালার বাসিন্দারাও জানে। তবু বিরোধী সমাজবাদী পার্টি বিনা লড়াইয়ে যোগীকে ওয়াকওভার দিতে রাজি নয়। যোগীর বিরুদ্ধে অখিলেশ যাদব প্রার্থী করেছেন শুভাবতী শুক্লকে। শুভাবতীর অকালপ্রয়াত স্বামী উপেন্দ্র ছিলেন বিজেপি-তে এবং তাঁর সঙ্গে যোগীর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে।
রাজা-মহারাজাদের হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকত। যোগী মহারাজের গরুশালে গরু। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
স্যর, গাই কে সাথ এক সেল্ফি লে সকতে হ্যায়?
গরুর সঙ্গে সেল্ফি তোলার অনুমতি? সাতসকালে এমন প্রশ্ন কে করে? এমন চমকপ্রদ কথা কে বলে! কিন্তু খুব চমকপ্রদও কি? হাজার হোক, গোরক্ষপুরের এই গোশালা তো জগদ্বিখ্যাত। যেমন বিখ্যাত এখানকার বাসিন্দা গরুরা। নইলে কি আর তাদের প্রহরায় মোতায়েন থাকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ইনসাস রাইফেলধারী বাহিনী!
পাঁচ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে বৃত হয়ে তিনি প্রথম এসেছিলেন এই গোশালাতেই। পালিত গরুকে তাঁর খাইয়ে দেওয়ার ছবিই ছিল নতুন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রথম ‘ফোটো-অপ’। তা হলে দর্শনার্থী আর কী দোষ করলেন?
প্রাচীনকালে রাজা-মহারাজাদের হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকত। যোগী মহারাজের গরুশালে গরু। শ’খানেক তো বটেই। তার চেয়ে বেশিও হতে পারে।
দেখলাম, গরুরা সেল্ফি তোলাতে বেশ দড়। ভরা পেট থাকলেও খাবারের জন্য সদা-উন্মুখ। এবং খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। পাঁচিল-ঘেরা গোশালার গেরুয়া রঙের গেটের কাছে লোকজন জমলেই তারা ভিড় করে আসছে। কখনও লোহার গেট লম্বা জিভ বার করে চেটে দিচ্ছে। কখনও মুখব্যাদান করছে। একে অপরকে ঠেলে সামনে আসতে চাইছে। তাদের ফোলানো নাকের পাটা থেকে বেরিয়ে আসা সমবেত ফোঁস-ফোঁস শব্দে সমীহ জাগে। আবার কৌতুক হয়, যখন দেখি, পাঁচিলের এপার থেকে তাদের কলা খাওয়াচ্ছেন কপালে তিলক-কাটা এক ভক্ত এবং সাদা পাঁচিলের ওপার থেকে জিভ বাড়িয়ে তা টেনে নিচ্ছেন গোমাতারা।
গোশালার সামনে একটা ফুটবিশেক চওড়া রাস্তা। তার পরেই শুরু হয়েছে গোরক্ষনাথের মন্দির চত্বর। আরও ভাল করে বললে, যোগী আদিত্যনাথের ধাত্রীগৃহ। যেখানে তাঁর অজয় মোহন বিস্ত থেকে ‘যোগী আদিত্যনাথ’ হয়ে ওঠা। ১৯৯০ সালে ঘর ছেড়ে এই গোরক্ষনাথ মঠে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। এই মঠ এবং মন্দির ‘নাথ’ সম্প্রদায়ের। যারা উত্তরপ্রদেশে ‘কানফট্টা যোগী’ বলে পরিচিত। অর্থাৎ, যাঁদের কান বেঁধানো থাকবে। চাইলে তাঁরা কানে কোনও অলঙ্কারও পরতে পারবেন। যেমন যোগী দু’কানে দু’টি সোনার ভারী দুল পরেন।
গোরক্ষপুর মঠে যোগীর গুরু ছিলেন মহন্ত অবৈদ্যনাথ। যিনি গোরক্ষপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদও ছিলেন। তাঁর পরে ওই আসনে টানা পাঁচবার সাংসদ হয়েছিলেন যোগী। অবৈদ্যনাথের মৃত্যুর পর যোগীই ছিলেন এই গোরক্ষপুর মঠের ‘মঠাধীশ’। এখন তাঁর পরিচয় ‘মহারাজ’। যে কারণে পাঁচিলঘেরা চত্বরের ভিতরে ছবি তোলার অনুমতি দেওয়ার সময় মন্দিরের বাইরের পুলিশ ক্যাম্প থেকে সতর্কীকরণ এল, ‘‘মহারাজের আবাস আর মন্দিরের ভিতরের ছবি তোলা নিষেধ।’’
যেটিকে ‘মহারাজের আবাস’ বলা হল, সেটি আসলে ‘মহারাজের প্রাসাদ’। হাল্কা এবং খানিকটা মেটে গোলাপি রঙের দোতলা বিশাল ইমারত। তকতক করছে। এতটাই পরিচ্ছন্ন। সেই প্রাসাদের একতলা এবং দোতলায় ঘরের পর ঘর। আবাসে বহিরাগতদের প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। প্রাসাদের একতলায় যোগী আদিত্যনাথের দফতর। কথিত, এই দফতর থেকেই এ বার তাঁর ভোট পরিচালনা করা হবে। যোগীর জীবনের প্রথম বিধানসভা ভোট। যে ভোটে যোগীবর প্রার্থী হয়েছেন গোরক্ষপুর (শহর) আসন থেকে।
২০১৭ সালে বিজেপি এক বিশাল ব্যবধানে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে জেতার পর আচম্বিতেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়েছিল যোগীকে (দুষ্টু লোকেরা বলে, যোগী নিজেই ঘোষণা করিয়েছিলেন)। তখন তিনি গোরক্ষপুরের সাংসদ। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়া পর তিনি বিধিবদ্ধ ভাবে উত্তপ্রদেশের বিধান পরিষদে নির্বাচিত হয়ে আসেন।
প্রসঙ্গত, দেশের কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার পাশাপাশি বিধান পরিষদ আছে (পশ্চিমবঙ্গে নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটি চালু করতে উদ্যোগী হয়েছেন)। যে কক্ষের সদস্যেরা নির্বাচিত হন বিধানসভার সদস্যদের ভোটে। ২০১৭ সালে বিজেপি-র যে বিপুল বিধায়ক সংখ্যা ছিল, তাতে বিধান পরিষদে একাধিক নেতাকে জেতানো যেত। যোগীর তাই ওই কক্ষের সদস্য হতে কোনও সমস্যা হয়নি। অর্থাৎ, যোগী উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য নন। এই প্রথম বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি।
গোরক্ষপুর (শহর) আসনে যোগী ড্যাং-ড্যাং করে জিতবেন, এটা তাঁর গোশালার বাসিন্দারাও জানে। তবু বিরোধী সমাজবাদী পার্টি (সপা) বিনা লড়াইয়ে যোগীকে ওয়াকওভার দিতে রাজি নয়। যোগীর বিরুদ্ধে অখিলেশ যাদবের সপা প্রার্থী করেছে শুভাবতী শুক্লকে। প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেস এবং মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টিও (বসপা)। আর রয়েছেন আজাদ সমাজ পার্টির প্রার্থী চন্দ্রশেখর আজাদ। ওরফে ‘রাবণ’। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই তরুণ দলিতনেতা অবশ্য পুরাকালের রাবণের মতো নন। তিনি ডেনিমের ট্রাউজার্স পরেন। চোখে ডিজাইনার রোদচশমা। বিভিন্ন সাময়িকী তাদের বিচারে এই ৩৫ বছরের যুবককে ‘ভবিষ্যৎ ক্ষমতাশালী’ বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তাঁর কোনও চিহ্ন গোরক্ষপুর শহরে পাওয়া গেল না। সম্ভবত শহরের বাইরে দলিত মহল্লায় প্রচারে গিয়ে থাকবেন।
ফলে যোগীর সঙ্গে মুখোমুখি টক্কর হচ্ছে সেই সপা-র শুভাবতীরই। অখিলেশ বিনা কারণে শুভাবতীকে যোগীর বিরুদ্ধে টিকিট দেননি। দিয়েছেন, কারণ শুভাবতীর অকালপ্রয়াত স্বামী উপেন্দ্র ছিলেন বিজেপি-তে এবং তাঁর সঙ্গে যোগীর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। বিজেপি-শ্রুতি: চার-চারবার ভোট লড়েও উপেন্দ্র একবারও জিততে পারেননি যোগীর ‘হাতযশে’। যদি সেই সুবাদে লড়ে যেতে পারেন উপেন্দ্রের বিধবা স্ত্রী।
গোরক্ষপুর অবশ্য যোগীতে, যাকে বলে আচ্ছন্ন। মুখ্যমন্ত্রিত্বের ব্যস্ততা সত্ত্বেও প্রতি মাসে অন্তত দু’বার এই মঠে আসেন যোগী। কখনও কখনও তারও বেশি। ইদানীং ভোটের প্রচারে ব্যস্ত থাকায় একটু কমই আসছেন। তার মধ্যেও শেষ এসেছিলেন দিন বারো আগে। ছিলেন যথারীতি এই মঠেই। ‘মহারাজের আবাসে’।
গোরক্ষপুর শহরের মধ্যেই গোরক্ষনাথের মঠ এবং মন্দির। বিশাল এলাকা। অন্তত কয়েকশো বিঘা তো হবেই। তেমনই তার পরিচ্ছন্নতা, যত্ন এবং পরিকাঠামো। পুরো মন্দির চত্বর বাঁধানো ব্ল্যাক গ্রানাইট আর সাদা মার্বেল পাথরে। জুতো-পায়ে চলতে চলতে সতর্কই থাকতে হয়। পাছে পা পিছলে যায়! এক পাশে বিশাল বাঁধানো জলাশয়। তাতে সন্ধ্যায় ফোয়ারা ওঠে। দিনে রাজহাঁস সাঁতরে বেড়াচ্ছে। তাদের প্যাঁক-প্যাঁক শব্দে চারদিক মুখরিত। কোথাও একটা ভজন বাজছে। সেই সুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রাজহাঁসের আপাত-কর্কশ ডাক।
মূল মন্দির পুরো মার্বেল পাথরের। ভিতরে গোরক্ষনাথ শিবের মূর্তি। মন্দিরের বাইরে একটা কাচের বাক্সে পিতলের তৈরি প্রমাণ সাইজের শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। তার মাথায় আর গোটানো পায়ের কাছে রাখা ভক্তির গাঁদাফুল।
মূল মন্দির ছাড়াও গোটা চত্বরটা জুড়েই ছোট ছোট মন্দির। গুনে দেখলাম, প্রায় ১০টা। আরও একটা বিশাল মন্দিরের কাজ চলছে। গোটাচারেক সমাধি। তার মধ্যে একটি যোগীর গুরু মহন্ত অবৈদ্যনাথের। যেমন ছোট ছোট মন্দির, তেমনই গোটা চত্বর জুড়ে ছোট ছোট পুলিশচৌকি। মন্দির চত্বরে ঢোকার মুখে প্রধান ফটকে পুলিশি প্রহরা। চারদিকে রাইফেল, ম্যানপ্যাক ওয়াকিটকি আর গেরুয়া ঝান্ডার ছড়াছড়ি। প্রধান ফটক অবশ্য বন্ধ। পাশের একটা চিলতে গেট দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা। সেখানে প্রথমে ডোরফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর। তার পরেও একপ্রস্ত হ্যান্ড-হেল্ড মেটাল ডিটেক্টর। সঙ্গে দেহতল্লাশি।
ভিতরেও স্বয়ংক্রিয় শস্ত্রধারী পুলিশ। স্বাভাবিক। হাজার হোক, এই মন্দির এবং মঠ উত্তরপ্রদেশের অন্যতম শক্তিধর রাজনীতিকের সাধনপীঠ। সাধে কি পুলিশবাহিনী ডিউটি শুরুর আগে জুতো খুলে ভক্তিভরে মূল মন্দিরে গিয়ে মাথা ঠুকে আসে! বাহিনীর কেউ কেউ কপালে তিলকও কাটেন। ঠিকই তো। ক্ষতি কী! যোগী তো আসলে সাধু। বাবা। মহারাজ।
লোকসভায় থাকাকালীন সাংসদদের বেতন এবং ভাতা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়াম্যান ছিলেন যোগী। তাঁর কমিটির সদস্য এক সাংসদের এখনও মনে আছে, যোগী নিজের নুন নিজের সঙ্গে রাখতেন। পাথুরে কালো রঙের নুন। কারণ, সেই সাংসদের কথায়, ‘‘উনি কারও হাতের নুন খান না।’’ কারও হাতের নুন খান না (অস্যার্থ— কারও নুন খাবেন না। যদি নিমকহারামি হয়ে যায়)। তবে সবসময়েই খান ঈষদুষ্ণ পানীয় জল। যোগীর ভাষায়, সেই সাংসদের কথায়, ‘‘গুনগুনা পানি। কোনও দিন কমিটির কোনও মিটিংয়ে ওই জল ছাড়া আর কিছু খাননি। এমনকি, কখনও চা খেতেও দেখিনি। অথচ, অনেক সাংসদই ওই লোভনীয় মেনু দেখে নিজেদের সামলাতে পারেন না।’’ সেই সাংসদের আরও মনে আছে, ‘‘যাঁরা কমিটির মিটিং হয়ে গেলে খাবার পরিবেশন করতেন, তাঁদের সবসময় ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলতেন যোগী। অন্য অনেক সাংসদের মতো তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। তাঁদেরই বলতেন, আপ মুঝে থোড়া গুনগুনা পানি লা দেঙ্গে?’’
সেই ঈষদুষ্ণ জল যোগী এখনও পান করেন কি না কে জানে! কিন্তু গোরক্ষপুরে তিনি যে রাবণ-টাবণ তথা অন্য প্রতিপক্ষকে জলের মতোই হজম করে ফেলবেন, তা নিয়ে কারও মনে বিশেষ সন্দেহ নেই। হতে পারে, তিনি গোরক্ষপুর নয়, দাঁড়াতে চেয়েছিলেন অযোধ্যা থেকে। হতে পারে, উত্তরপ্রদেশে যে ক’টি মফস্সল শহরে একটু বেশি উন্নতি হয়েছে গত পাঁচবছরে, গোরক্ষপুর তাদের অন্যতম। কিন্তু অতসব না-করলেও হত। যোগীর এতটাই প্রভাব, প্রতিপত্তি এবং প্রতাপ গোরক্ষপুরে।
ভোটার তো বটেই, যোগীর গোশালার পোষ্য গরুরাও জানে, ‘অন্যরকম’ কিছু হবে না। (চলবে)