লেখা উচিত ছিল অযোধ্যা বা ফৈজাবাদ। কিন্তু ধন্নিপুরের এতটাও ‘অচেনা’ থাকা ঠিক নয়। হাজার হোক, এখানেই তো বাবরি মসজিদের বিকল্প মসজিদ তৈরি হচ্ছে। ধন্নিপুর হল অযোধ্যার অদূরে ফৈজাবাদ জেলার (সরকারি ভাবে অযোধ্যা জেলারই) একটি গ্রাম। ভারত সরকার সেখানে বাবরির বিকল্প মসজিদ তৈরির করার জন্য পাঁচ একর কৃষিজমি দিয়েছিল।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরটা অন্যরকম হলে এই লেখা লিখতে হত না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ডেসপ্যাচ শুরু করার আগে উপরের ডেটলাইনে লিখলাম বটে ‘ধন্নিপুর’। হেডিংয়েও। কিন্তু তাতে সাংবাদিকতার একটা পাঠ এবং শিক্ষাকে অবজ্ঞাই করা হল। যে, কখনও কপির ডেটলাইনে বা হেডিংয়ে অচেনা জায়গার নাম রাখা উচিত নয়।
সেই ব্যাকরণ কঠোর ভাবে মানতে গেলে লেখা উচিত ছিল অযোধ্যা বা ফৈজাবাদ। কিন্তু মনে হল, ধন্নিপুরের এতটাও ‘অচেনা’ থাকা ঠিক নয়। হাজার হোক, এখানেই তো অযোধ্যার বাবরি মসজিদের বিকল্প মসজিদ তৈরি হচ্ছে।
কিন্তু ধন্নিপুর কোথায়?
ধন্নিপুর হল অযোধ্যার অদূরে ফৈজাবাদ জেলার (সরকারি ভাবে অযোধ্যা জেলারই) একটি গ্রাম। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সরকার সেখানে বাবরি মসজিদের বিকল্প মসজিদ তৈরির করার জন্য পাঁচ একর কৃষিজমি দিয়েছিল। জমির মালিকানা দেওয়া হয়েছিল ‘উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড’-কে।
২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোতে এগোতে পথচলতি মানুষকে প্রশ্ন করতে করতে ধন্নিপুরে পৌঁছনো গেল অবশেষে। সরু গাড়ি-চলা রাস্তা। হাইওয়ে থেকে কয়েকশো মিটার দূরে। সেখানে একটা বিশাল জমির মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা রঙের মাজার। জনশ্রুতি, এই মাজারের বয়স অন্তত সাড়ে সাতশো বছর। এলাকার লোকেরাই মাজারের দেখভাল করেন। সবুজ রংয়ের ফটক। মাজারের মাথার উপরে একটা ঝাঁকড়া পাকুড় গাছ। তার ছায়ায় ছায়া হয়ে রয়েছে আশপাশ। মাজারের সাদা দেওয়ালে সম্ভবত কিছুদিন আগেই কলি ফেরানো হয়েছে।
চারপাশে জনমনিষ্যি নেই। বড্ড বেশি চুপচাপ। দেখেশুনে অধুনাপ্রয়াত একে হাঙ্গল অভিনীত ‘শোলে’-র ইমামের মতো বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘‘ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?’’
মসজিদটাই বা কোথায় তৈরি হচ্ছে? ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর কেটে গিয়েছে ঠিক দু’টি বছর। এটা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি। দু’বছর ধরে ‘ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন’-এর তত্ত্বাবধানে এখানে মসজিদ তৈরির কাজ চলছে বলে যা শুনে কলকাতা থেকে আসা, নির্মীয়মাণ সেই মসজিদ কোথায়! যতদূর তাকাই, চারদিকে তো ধু-ধু ফাঁকা জমি। ছাগল চরছে। আরও অন্তত গোটাচারেক বোর্ড সেই ‘ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন’-এর। এ ছাড়া আর কোথাও কোনও প্রাণের নড়াচড়া নেই। কিছু দূরের ক্ষেতে কাজ করছেন এক মহিলা। কিন্তু অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে না। জমির সামনে রাস্তার অন্যপারে কিছু খুচরো বাড়ি আর দোকান। কিন্তু সেখানে ইতিউতি ঘোরাফেরা-করা কারও কথা বলার সময় নেই। জুম্মাবারের নমাজের সময় হয়ে গিয়েছে।
তখনই চোখে পড়ল মাজারের ফটকের সামনে রাখা জং-ধরা প্রবীণ সাইকেলটা। তিন ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মাজারে ঢুকতে হয়। সেই সিঁড়ির গোড়ায় একজোড়া নীল রঙের হাওয়াই চপ্পল।
ফটক ঠেলে গলা বাড়িয়ে জোরে বললাম, ‘‘আসসালামু আলাইকুম।’’
মাজারের ভিতর থেকে প্রতিসম্ভাষণ এল, ‘‘ওয়ালেকুম সালাম।’’ জীর্ণ সাইকেল আর হাওয়াই চপ্পলের মালিক তার পর দেখা দিলেন নিজে। মাথায় একটা সাদা কাপড় কাফনের মতো করে বাঁধা। পরনে খুব সাধারণ শার্ট-ট্রাউজার্স। হাতছানি দিয়ে ডাকায় বাইরে এলেন তিনি। নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় বললেন, শ্রীপ্রসাদ সাঁই। তিনি কি হিন্দু? হ্যাঁ। তা হলে মাজারে কী করছেন? জবাব এল, ‘‘সাঁইরা দুই ধর্মেরই লোক। আমরা হিন্দু-মুসলিম দু’ধর্মেই থাকতে পারি। এটা খাজাবাবার মাজার। এখানে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের লোকই আসে। আমি তো মাজারে প্রার্থনা করতে এসেছি। তাতে ক্ষতি কী আছে?’’
শ্রীপ্রসাদকে বলা যেত, আপনার মতো দার্শনিক যদি সকলে হতেন, তা হলে তো আর মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদটাই ভাঙত না! দেশের রাজনীতিটা অন্যরকম হয়ে যেত না। বা লখনউয়ের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এই জমিতে বিকল্প বাবরি মসজিদ তৈরিরও প্রয়োজন পড়ত না।
তবে শ্রীপ্রসাদ আর কিছু জানেন না। এখানে মসজিদ তৈরি হবে বলে শুনেছিলেন। কিন্তু তার বেশি কিছু শোনেননি। জানেনও না। প্রশ্ন করলে বলেন, ‘‘ইমামকে প্রশ্ন করুন।’’ কিন্তু ইমামকে পাব কোথায়? শ্রীপ্রসাদ তা-ও জানেন না।
সরকারি জমিটি ফুটছয়েক উঁচু কংক্রিটের খুঁটি আর কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যে জমিতে অব্যবহার এবং অযত্নে ফুটেছে অজস্র জংলি ফুল। জমি ঘিরে একদিকে আমগাছের সারি। অন্যদিকে আরও অন্যকিছু নাম-না-জানা গাছ। বাকিটা ছোটখাট তেপান্তর। একটা ইটও পড়েনি! কিন্তু বোর্ডে প্রস্তাবিত মসজিদের ছবি আছে। আলিশান ইমারত। ছবির একেবারে মাঝখানে এই খাজাবাবার মাজার। একঝলক দেখেই বোঝা যায়। মাজারের বাঁ-পাশে গম্বুজের মতো মসজিদ। ডানপাশে পর পর দু’টি হর্ম্য। অত্যাধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন। ফোটোশপ করা ছবিই হবে। কিন্তু দেখেই তাক লেগে যায়! তবে সবমিলিয়ে যত না মসজিদ চত্বর, তার চেয়ে অনেক বেশি ঝকঝকে অত্যাধুনিক ‘কনভেনশন সেন্টার’ মনে হয়।
ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করি-কী করি। নজরে এল একটা চেহারা। কখন যেন রাস্তার পাশের কংক্রিটের বেঞ্চে এসে বসেছে। হাফহাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। গলায় কালো কারে বাঁধা তাবিজ। খপাত করে গিয়ে ধরলাম। জানা গেল, জমির পাশে রাস্তার ওপারের বাড়িটা তাঁরই। নাম মহম্মদ ইসলাম খান।
দু’বছর কেটে গিয়েছে। মসজিদ তৈরি শুরু হয়নি? কমিটির লোকেদের তো মসজিদ তৈরি শুরু করে দেওয়ার কথা ছিল।
ইসলাম খান জবাব দেন, ‘‘কিসের মসজিদ? কোথায় কমিটির লোক? তারা বছরে বারদুয়েক আসে। ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগস্ট। এসে ঝান্ডা ওড়ায়। গাছ পোঁতে। তার পর ঘুরেফিরে চলে যায়। একটা অ্যাম্বুল্যান্স পাঠিয়েছিল জনসেবার জন্য। তা-ও দু’বছর আগে!’’ শেষ বাক্যটায় কি খানিক শ্লেষ ছিল? ইসলাম খানের পরের বাক্যগুলো শুনে তেমনই মনে হচ্ছিল, ‘‘আমাদের এখানে মসজিদ করে কী হবে? আমাদের এখানে ১৩-১৪টা মসজিদ আছে। নমাজ পড়ার জায়গার অভাব নেই। তার চেয়ে যদি একটা বড় স্কুল হত, কলেজ হত বা একটা হাসপাতাল হত, তা হলে এলাকার অনেক সুবিধে হত। একটা মাত্র প্রাইমারি স্কুল আছে মেয়েদের। সেটাও ক্লাস এইট পর্যন্ত। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে লখনউ পর্যন্ত নিয়ে যেতে যেতে রাস্তাতেই মরে যায়। এখানে আট-দশ হাজার লোকের বাস। হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজ হলে তাদের সকলের সুবিধে হত। আমাদের এখানে একটা ভাল স্কুল দরকার।’’
কিন্তু ইসলাম খানেরা যা-ই বলুন, বিজেপি তো চাইছে এই জমিতে মসজিদই হোক। প্রবীণকে বললাম সে কথা। শুনে তিনি বললেন, ‘‘ইসলাম ধর্মে বলে, একটা মসজিদের জিনিসপত্র নিয়ে অন্য মসজিদ তৈরি করা যায় না। এক মসজিদকে কাঙাল করে অন্য মসজিদ তৈরি করে তাকে সাজানো যায় না। তা হলে অন্য একটা মসজিদের জমি নিয়ে কী করে এখানে আর একটা মসজিদ হবে? আমরা তো এটাই চাই না যে, এই মসজিদের নাম ‘বাবরি মসজিদ’ রাখা হোক। আমরা বলেছি, বরং হাসপাতালের নামটা ‘বাবরি হাসপাতাল’ রেখে দিক!”
ইসলাম খানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এসে দাঁড়ালেন এলাকার বাসিন্দা বিকাশ যাদব। তরুণ বয়সের বিকাশ ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করেন। গত ১২ বছর আছেন ধন্নিপুরে। প্রবীণ ইসলামের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘‘আমরা এখানে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে থাকি। এই এলাকায় হিন্দু-মুসলিম ৫০-৫০।’’ তাঁকে থামিয়ে ইসলাম খান বলেন, ‘‘এই জমিতে হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজ হলে এলাকার হিন্দুরাও তো তার সুবিধে পাবে। তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরাও তো পড়াশোনা করতে পারবে সেই স্কুল-কলেজে। হাসপাতাল হলে তাদের পরিবারের লোকেরাও তো চিকিৎসা করাতে পারবে। মসজিদ হলে কি আর হিন্দুরা সেখানে যেতে পারবে?’’
ভোট কাকে দেবে ধন্নিপুর?
ইসলাম খান এ বারও সজুত, ‘‘সপা-কে (সমাজবাদী পার্টি) দেব। আমরা সপা-র সঙ্গে আছি। দেখুন, আমাদের এখানে যে কাজ করে, সে ভোট পাবে। অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় কাজ করেছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছর বিজেপি জনতাকে লুটেছে। পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। শুনুন, শুধু মুসলিমরা নয়, ধন্নিপুরের হিন্দুরাও সপা-কেই ভোট দেবে। অখিলেশ যাদব সরকার গড়তে পারলেও দেবে, না-পারলেও দেবে।’’
কিন্তু মসজিদ কবে হবে ধন্নিপুরে? বাবরি মসজিদ?
জুম্মার নমাজে যেতে যেতে ইসলাম খান বলে যান, ‘‘আমার বয়স এখন ষাট। মনে হয় না মসজিদটা দেখে যেতে পারব।’’
ধন্য ধন্নিপুর! (চলবে)