মথুরার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দুরা বলছেন, নরসিংহ রাওয়ের আমলে সংসদে বিল পাস হয়েছিল যে, অযোধ্যা ছাড়া যে যে জায়গায় মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি আছে, তারা সেখানেই অটুট থাকবে। ফলে এই মসজিদের কিছু করতে গেলে প্রথমে সংসদে গিয়ে সেই বিল ফেরাতে হবে। তা অত সহজ নয়।
মথুরার মন্দিরে পুণ্যার্থীরা স্বাগত। কিন্তু মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ গত ৬ ডিসেম্বর থেকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ঠহরিয়ে! থামুন! আর যাওয়া যাবে না!
কেন যাওয়া যাবে না? যাবে না, কারণ বাইরের লোকের ভিতরে যাওয়া নিষেধ। খুব কেঠো এবং কেজো গলায় বললেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দুই শস্ত্রধারী খাকি উর্দি। কয়েকশো ফুট দূরে শাহি মসজিদের গম্বুজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার খিলান। সামনে প্রশস্ত চবুতরা। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। গোলমাল নেই। তা হলে কেন যাওয়া যাবে না ভিতরে?
—সেটা তো আমরা বলতে পারব না। কিন্তু বাইরের লোককে ভিতরে যেতে দেওয়া নিষেধ। এখান থেকে সরে যান। ওই রেললাইনে ওপারে গিয়ে দাঁড়ান। তার পর যার সঙ্গে খুশি কথা বলুন। যত খুশি ছবি তুলুন।
বুঝলাম, দুই জাঠ পুলিশকর্মীকে সাংবাদিকের পরিচয়পত্র দেখিয়েও কোনও লাভ নেই। কারণ, দু’পা সরে এসে কথা বলতে দিতেও তাঁরা নারাজ। উপরের ওয়াচ টাওয়ারের সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে আঙুল তুলে তাঁরা বলছেন, ‘‘এখানে দাঁড়াবেন না। ক্যামেরা সব দেখছে। ওহ্ বহত বারিকি সে দেখতা হ্যায়।’’ ক্যামেরার লেন্স সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। অগত্যা কেটে পড়তে হল।
কোলাপসিব্ল গেটের বাইরে থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে খানিক নীচের রেললাইনে। সিঁড়ির ধাপে বসে কিছু চেহারা গজল্লা করছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলতে দিতেও ভারী আপত্তি আইনরক্ষকদের। আগে রেললাইনের লক্ষ্মণরেখার বাইরে যেতে হবে।
যে রেললাইনের কথা লিখছি, সেই রেললাইন ধরেই এসেছি শাহি মসজিদের প্রধান ফটকে। লাইনের একপাশে কে জানে কত যুগ ধরে জমে-থাকা জঞ্জালের স্তূপ। অন্যপাশে কাঁচা গোবরের ঘুঁটের পাহাড়। লাইনে পড়ে রয়েছে রেলে-কাটা ছাগল আর কুকুরের কয়েকদিনের দেহ। রাইগর মর্টিস ধরে শক্ত হয়ে গিয়েছে। ট্রেনের ধাক্কার অভিঘাতে দেহ থেকে বেরিয়ে-আসা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। মাছি ভনভন করছে।
এই লাইন ধরে ট্রেন যায় মথুরা থেকে বৃন্দাবনে। এক কামরার ট্রেন। স্থানীয়েরা রসিকতা করে বলেন ‘রেল-বাস’। মানে, বাসের মতো একটা বাক্স। একটাই। সেটাই লটরপটর করতে করতে যায় এবং ফেরত আসে।
‘শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরা মে আপ কা স্বাগত হ্যায়’। শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় আপনাকে স্বাগত। কিন্তু আপনি স্বাগত নন মথুরার শাহি মসজিদে। গত ৬ ডিসেম্বর থেকে এই মসজিদে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মসজিদের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলাও বারণ। কবে এই নিষেধাজ্ঞা উঠবে কে জানে!
তিরিশ বছর আগে অযোধ্যার বিতর্কিত সৌধ ভাঙার সময় স্লোগান উঠেছিল, ‘ইয়ে তো সির্ফ ইক ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। অর্থাৎ, এ তো সামান্য ঝলক। এখনও কাশী-মথুরা বাকি। অর্থাৎ, এর পর কাশী আর মথুরার পালা। সেখানেও মসজিদ ভেঙে মন্দিরই একচ্ছত্র আধিপত্য রাখবে।
মথুরার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং ওয়াকিবহাল হিন্দুরা বলছেন বটে, নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে সংসদে বিল পাস হয়েছিল যে, অযোধ্যা ছাড়া যে যে জায়গায় মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি আছে, তারা সেখানেই অটুট থাকবে। অযোধ্যায় তো মন্দিরই ছিল না। কাশী-মথুরায় মন্দিরও আছে। মসজিদও। ফলে এই মসজিদের কিছু করতে গেলে প্রথমে সংসদে গিয়ে সেই বিল ফেরাতে হবে। তা অত সহজ নয়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের আবহে আবার কৃষ্ণ জন্মভূমি আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছে। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এক-দেড় বছর আগে। একটি হিন্দু সংগঠন দাবি তুলেছিল, তারা মসজিদে ঢুকে ‘জলাভিষেক’ করবে। তার পরেই প্রশাসন মসজিদের আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে। তারই আরও কড়াক্কড় ছবি দেখল কলকাতা থেকে-যাওয়া সাংবাদিক।
মসজিদের সঙ্গে মন্দিরের তফাত ফুট দশেকের। প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো মথুরার কৃষ্ণের মন্দির আর শাহি মসজিদের ইদগাহ। কিন্তু ফটক আলাদা। সেই জন্যই নাকি এখনও শান্তি বজায় আছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। ৫০-৫৫ বছর আগে দুই দেওয়ালের মাঝ বরাবর নাকি পাঁচিল তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। তা এখনও শেষ হয়নি। মসজিদে এখনও থাকেন ৩০-৩৫টি মুসলিম পরিবার। তাঁদের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হল লক্ষ্ণণরেখার এপারে দাঁড়িয়ে। মহম্মদ সিরাজুদ্দিন বললেন, ‘‘মসজিদ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়া হয়। এখনও হয়। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে থাকি। কোনও দিন কোনও দাঙ্গা-ফসাদ হয়নি। জন্মাষ্টমীর সময় বাইরে থেকে কিছু লোক এসে হল্লা করে প্রতিবার। কিন্তু তার কোনও ছাপ মথুরার মুসলিমদের উপর পড়েনি। পড়বে বলে মনেও হয় না।’’
কিন্তু এই যে মাসদুয়েক আগে মথুরা নগরীকে পুরোপুরি নিরামিষাশী করে দেওয়া হল?
সিরাজভাই হাসেন, ‘‘সে আর কী করা যাবে! যখন যে ক্ষমতায় আসবে, সে তার মতো করে চালাবে। ওরা (যোগী আদিত্যনাথ) ক্ষমতায় আছে। তাই মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। আমরা (অখিলেশ যাদব) ক্ষমতায় এলে সেটা উল্টে যাবে।’’
শুধু আমিষ বন্ধ? এ শহরে কৃষ্ণের ছড়াছড়ি! স্বাভাবিক। এ শহর কৃষ্ণের জন্মস্থান। কথিত, কৃষ্ণের মাতুল কংসরাজ এখানে সাতটি কারাগার তৈরি করেছিলেন। মোগল বাদশাহ অওরঙ্গজেব ছ’টি কারাগার ভূলুণ্ঠিত করে তার উপর শাহি মসজিদ রচনা করেছিলেন। সপ্তম কারাগারটি বেঁচে গিয়েছিল। সেখানেই কৃষ্ণের জন্ম। সপ্তমটি কী ভাবে বেঁচে গেল? প্রশ্ন শুনে একগাল হাসেন স্থানীয় যুবক বিবেক শর্মা, ‘‘আরে, সাতনম্বর কারাগারটা বাকি ছ’টা ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়েছিল না? তাই বেঁচে গিয়েছিল।’’
আরও বলেন, ‘‘আগে তিনদিক থেকে মন্দির দেখা যেত। কিন্তু একদিক থেকে মসজিদের সবুজ-সাদা উঁচু গম্বুজ দেখা যেত। সেটা ঢাকা দেওয়ার জন্য ১৯৬৯ সালে যুগলকিশোর বিড়লা এবং মদনমোহন মালব্য নতুন মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।’’ বলেন, ‘‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাঁচটি লীলাভূমি। এক, মথুরা। তাঁর জন্মভূমি। দুই, গোকুল। পালনপোষণ ভূমি। তিন, বৃন্দাবন। রাসলীলার ক্ষেত্র। যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান নে ডান্স কিয়া থা। চার, গোবর্ধন। যেখানে ভগবান পাহাড় উঠিয়েছিলেন। আর পাঁচ, বরসানা। যেখানে কৃষ্ণ ভগবান হোলি খেলেছিলেন। লটঠমার হোলি (যেটা লাঠিতে লাঠির বাড়ি মেরে খেলা হয়)।’’
বিবেক মথুরায় গাইডের কাজ করেন। পুণ্যার্থী বা ‘যাত্রী’-প্রতি ৫০ টাকা তাঁর পারিশ্রমিক। একটা সময়ে দিনে সাত-আটজন যাত্রী হত। করোনা-উত্তর কালে সেটা গিয়ে ঠেকেছে দিনে দু’তিনজনে। মথুরায় বিবেকের মতো শ’পাঁচেক গাইড আছেন। সকলেই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ না হলে গাইড হওয়া যায় না। কিন্তু এই যে গড়গড়িয়ে মন্দির-মসজিদের ইতিহাস বলতে বলতে গাইডগিরি করছেন, ইতিহাস পড়েছেন? বিবেক আবার শিশুর মতো সরল হাসেন, ‘‘ব্রাহ্মণকে আবার পড়াশোনা করতে হয় নাকি! ব্রাহ্মণ তো সব জানে। তারা তো সব জেনেই জন্মায়।’’
এই সর্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণ অবশ্য জেনে তাজ্জব হলেন যে, কলকাতা থেকে-আসা ‘পত্রকার’ না গেলেন মন্দির দর্শনে, না গেলেন গোকুলে (যেখানে নাকি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লুট-লুটকে মাখন খায়ে থে’)। মহাপাতকীর কাজ করলাম নিশ্চয়ই। যাক গে যাক!
এই ব্রাহ্মণ আরও জানালেন, আগরায় সভা করতে এসে যোগী আদিত্যনাথ বলে গিয়েছেন, বিজেপি আবার উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় এলে এই মসজিদ সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে পাশাপাশিই বললেন, ‘‘মসজিদ হটানা চাহিয়ে জরুর। মগর পেয়ার সে। কোই দাঙ্গা-ফসাদ হোনা নহি চাহিয়ে। তেমন হলে অনেক গরিব মানুষ মারা পড়বে। দোকান জ্বলবে। কিন্তু বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে এই মসজিদ থাকবে না।’’
হয়তো থাকবে না। হয়তো সেই কারণেই মথুরার রাস্তা, ফুটপাথ সমস্ত নতুন করে সারানো শুরু হয়েছে। সেই কারণেই কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরের প্রধান ফটকের অদূরে নতুন করে বিশাল তোরণ তৈরি করছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। সেই নির্মাণকাজের জন্য মন্দিরের সামনে দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ। এককালে জমকালো দোকানগুলো মাছি তাড়াচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসার। কারণ, মথুরা জেলার অর্থনীতির ৬০ শতাংশই পুণ্যার্থী-নির্ভর। কিন্তু কে কার কথা শোনে! ধর্ম আছে তো। কৃষ্ণ জন্মভূমি বলে কথা! মেটে রঙের পাথরের সেই তোরণের উপরেও লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি, উত্তরপ্রদেশ ব্রজতীর্থ বিকাশ পরিষদ’।
ব্রজ বলে ব্রজ! তীর্থ বলে তীর্থ! মথুরা শহরে প্লাইউডের দোকানের নাম ‘কৃষ্ণ’। মিষ্টির দোকানের নাম ‘ব্রজবাসী’। মার্গের নাম ‘রাধাকৃষ্ণ’। সেলুনের নাম ‘নন্দলালা’। শহরের প্রতিটি দিগ্নির্দেশ মূলক সরকারি সাইনপোস্টে ননীর ভাণ্ড সঙ্গে নিয়ে ননীগোপালের ছবি। যাকে এখানে আদর করে ‘লাড্ডুগোপাল’ বলা হয়। মন্দিরে যাওয়ার অলিগলিতেও বিকোচ্ছে ফ্রেমবদ্ধ সেই ছবি। বিকোচ্ছে খঞ্জনি। ভজনের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য। তিনটে ১০০ টাকা। একটু দরাদরি করলে চারটেও পাওয়া যেতে পারে। বিশেযত, যদি বউনির সময় হয়। কে বলবে, এই মথুরা একটা ক্যান্টনমেন্ট শহরও বটে। রাস্তার পাশে সেনার দফতর। কামান, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমানের স্মারক রাখা। কিন্তু সেই এলাকাটুকু পেরিয়েই আবার ‘লাড্ডুগোপাল’।
সেই লাড্ডুগোপালের দোহাই দিয়েই শাহি মসজিদ পর্যন্ত যেতে চাইলেন না বিবেক। সাফ বললেন, ‘‘আপনি রেললাইন ধরে যান। আমি কোনওদিন ওখানে যাইনি। যাবও না। আপনি ঘুরে আসুন। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি আপনার জন্য।’’ হিতৈষীর গলায় আরও বললেন, ‘‘কী করবেন ওখানে গিয়ে! কেউ থাকে না ওখানে। সাফ-সাফাই হয়। কিন্তু নমাজও পড়া হয় না।’’
ঘণ্টাখানেক পর রেললাইন ধরে ফেরত আসতে আসতে মনে পড়ছিল সিরাজুদ্দিনের কথা, ‘‘কে বলল, মসজিদে নমাজ পড়া হয় না? রোজ পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়া হয়। আমরা ওখানে থাকি। আমরা জানি না?’’
ফিরে এসে বিবেককে বললাম, নমাজ তো পড়া হয় মসজিদে। বিবেক আবার শিশু, ‘‘হতে পারে। কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে। ভোঁপু (লাউডস্পিকার) নহি বাজাতা হ্যায় না? সে সাহস ওদের নেই!’’
সাহস কি যোগী আদিত্যনাথেরও আছে? মথুরার কয়েক শতাব্দী প্রাচীন শাহি মসজিদকে সরিয়ে দেওয়ার? মথুরাকে আরও একটা অযোধ্যা বানানোর? সে তিনি যতই নির্বাচনী ভেঁপু বাজান না কেন। মথুরা তো আর একটা অযোধ্যা চাইছে না। (চলবে)