তাজমহল আছে। কিন্তু সেই শাহজাহানও নেই। সেই যমুনাও নেই। সেই বাজপেয়ী নেই। সেই ‘লাভার্স বেঞ্চ’ নেই। সেই আগরাও নেই। মেরুকরণের রাজনীতির পিঠে সওয়ার রাজনীতিকরা সেই প্রেমের শহরের বিশ্ববিখ্যাত প্রণয়-অভিজ্ঞানের নাম বদলে তাকে রাজনীতির ঘুঁটি করতে চাইছেন। তাঁদের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তাজমহল আর ভালবাসার নিশান নয়। রাজনীতির ঘুঁটি হয়ে গিয়েছে। তাজমহলও।
হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি উত্তরপ্রদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। প্রেমের শহর হতে পারে। কিন্তু আগরারও তা থেকে মুক্তি নেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নাহ্, পাওয়া গেল না। গোটা আগরা শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও ভোটের একটাও পোস্টার, হোর্ডিং, কাট-আউট— কিস্যু পাওয়া গেল না! তাজমহলের এই শহর কি উত্তরপ্রদেশের বাইরে? এখানে ভোট-টোট কি আদৌ হয়নি নাকি?
আগরা এসেছিলাম একুশ বছর আগে। ২০০১ সালে। সেই প্রথম এবং অদ্যাবধি সেই শেষ। এসেছিলাম ভারত-পাকিস্তানের শীর্ষবৈঠক কভার করতে। এই শহরের জেপি প্যালেস হোটেলে সেই বৈঠক করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী-পারভেজ মুশারফ। চিরকালীন এবং শাশ্বত প্রেমের সৌধ যে শহর ধারণ করে আছে যুগ যুগ ধরে, সেই শহরের জমিতেই শত্রুতার ইতিহাস ভুলে পড়শি দেশের সঙ্গে সৌভ্রাতৃত্ব এবং ভালবাসার কাহিনি শুরু করতে চেয়েছিলেন বাজপেয়ী। মুশারফ রাজি হয়েছিলেন। দু’জনেই বৈঠকে বসেছিলেন ‘ইতিবাচক’ মানসিকতা নিয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের একান্ত বৈঠক ঠিকঠাক গিয়েছিল। সুপবন বহিতে শুরুও করিয়াছিল। এতটাই যে, তাজমহল চত্বরের ‘লাভার্স বেঞ্চ’-এ বসে পোজ দিয়েছিলেন সস্ত্রীক মুশারফ। অমর ছবি।
কিন্তু ঘটনাচক্রে, সে দিন রাতে দু’পক্ষের শীর্ষবৈঠক ভেস্তেই গিয়েছিল। কারণ, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম কাশ্মীর। ভারত বলেছিল, উগ্রপন্থার অভিযোগে অভিযুক্ত কাশ্মীরিরা ‘জঙ্গি’। পাকিস্তান বলেছিল, নাহ্, তারা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’। দু’পক্ষের সেই আকচাআকচিতে যৌথ ঘোষণাপত্র লেখা সম্ভব হয়নি। মাঝরাতে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর আর সময় নষ্ট করেননি পাক প্রেসিডেন্ট। আগরা থেকে অজমের শরিফ যাওয়ার কথা ছিল সস্ত্রীক মুশারফের। কিন্তু বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় সে যাত্রা অজমের শরিফের দরগায় আর চাদর চড়াতে যাননি মুশারফ। পরদিন কাকভোরেই বেগমকে নিয়ে তাঁর বিশেষ বিমানে আগরা থেকে সটান ইসলামাবাদ রওনা দেন।
তখন যমুনাপারের এই শহরে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, এ বার তার ছিটেফোঁটাও কোথাও দেখতে পেলাম না। আগরার ভোটাররা ভোট দিয়েছেন একেবারে প্রথম দফায়, ১০ ফেব্রুয়ারি। ফলে উত্তাপ কিছু তৈরি হয়ে থাকলেও এখন আর তা নজরে পড়ার কথা নয়। মানছি। কিন্তু একটা রেশ তো থাকবে অন্তত! কিচ্ছু নেই। ওই যে বললাম, সারা শহর ঘুরে একটিও ভোটের পোস্টার, হোর্ডিং বা কাট-আউট চোখে পড়ল না।
ঘিঞ্জি শহর। ততোধিক ঘিঞ্জি মহল্লা। আগরা শীর্ষবৈঠক সংক্রান্ত কাজ করতে এসে যে শহরটাকে দেখেছিলাম, তা প্রায় ভোজবাজির মতো উবে গিয়েছে! মলিন আর গরিব হয়ে গিয়েছে আগরা। হতে পারে কোভিডকালে গত দু’বছরে সারা দেশের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে এই শহরের অর্থনীতিও ধ্বস্ত। হতে পারে, মানুষের চাকরি-বাকরি নেই। হতে পারে, ভোট-টোট নিয়ে সত্যিই তাঁদের কিছু যায়-আসে না। অনেকে বললেন বটে, ভোটের পোস্টার-হোর্ডিং গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়েই বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু তা বলে একটাও চোখে পড়বে না! পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা চোখ ধাক্কা খাচ্ছে তো।
বরং চোখে পড়ল অজস্র পর্যটক। যদিও তাঁদেরও পরিমাণ আহামরি নয়। তবু কমই বা কী! যাঁরা তাজমহলের সামনে হুলিয়ে ছবি তুলছেন এবং তোলাচ্ছেন, তাঁদের সমবেত কিচিরমিচিরে মিশে আছে তামিল, তেলুগু, হিন্দি, গুরমুখী এমনকি, বাংলাও। কোভিডের সময় তাজমহল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একেকটা ঢেউ চলে যাওয়ার পর আবার খুলে দেওয়া হয়েছে শাহজাহানের তৈরি প্রেমের অমর সৌধ। কিন্তু গাইডরা আক্ষেপ করছেন, ‘‘বিদেশি ট্যুরিস্ট এখনও আসছে না। কোনও কাম-ধান্দা হচ্ছে না। রুটিরুজি উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোক আসা শুরু হয়েছে।’’
তাজমহল এখন আধা সামরিক বাহিনীর কব্জায়। অনলাইনে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। একুশ বছর পর খানিকটা অচেনাই লাগছিল। তাজমহলমুখী পিচের রাস্তা বদলে গিয়েছে পাথরের রাস্তায়। ব্যাটারিচালিত গাড়ি চালু হয়েছে পর্যটকদের শিল্পগ্রাম পার্কিং থেকে তাজমহলের প্রধান ফটক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। চারদিকে আরও গাছপালা লাগানো হয়েছে। চারদিকটা বেশ একটা ছমছম করছে। মেটাল ডিটেক্টর, খাকি উর্দি, ম্যানপ্যাক্ট— একটা ‘হেরিটেজ সাইট’ মার্কা গেরামভারী ভাব ঝুলছে গোটা আবহে।
চত্বরের ভিতরে ঢুকে সবচেয়ে আগে যেটা চোখে পড়ল— ‘লাভার্স বেঞ্চ’ আর সেই জায়গাটায় নেই। আগে মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই সামনে রাখা ছিল শ্বেতপাথরের বেঞ্চটা। এখন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে শ্বেতপাথরের সারি সারি চৌখুপির মধ্যে বসানো ফুলের টব।
যেমন চারদিকে সারি সারি গরিব মানুষ। কোভিড-আক্রান্ত অর্থনীতির বলি হয়ে তাজমহলের অদূরে পার্কিং লটে ঘুরছেন থরে থরে হকার। পর্যটক দেখলে এঁটুলির মতো গায়ে লেগে থাকেন। অনবরত পিছু পিছু আসতে থাকেন। হাল ছাড়েন না। দাম কমাতে কমাতে একেবারে তলানিতে নিয়ে যান। খদ্দের তাও টলছে না দেখে নাচার গলায় বলেন, ‘‘করোনায় মরিনি। না-খেতে পেয়ে মারা পড়ব সাহেব। সকাল থেকে একটাও বিক্রি হয়নি। একটা কিছু নিয়ে যান!’’
ভোটের কথা জিজ্ঞাসা করলে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকেন। বুঝি, কোনও উৎসাহ নেই। মায়া হয়। খারাপ লাগে।
ভোট নেই। কিন্তু রাজনীতি কি থাকবে না? আছে। আলবত আছে! হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি উত্তরপ্রদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। পাকেচক্রে। পাকে পাকে। প্রেমের শহর হতে পারে। কিন্তু আগরার তা থেকে মুক্তি নেই। তাজমহলেও ঢুকে পড়েছে সাম্প্রতিক হিজাব-বিতর্ক। আর ঢুকেছে এমনই জোরদার হয়ে যে, হিন্দু কট্টরপন্থীরা গেরুয়া বসন পরিধান করে তাজমহল চত্বরে ঢুকে ‘হনুমানচালিসা’ পাঠ করার কর্মসূচি নিয়ে বসেছেন! দর্শনার্থীদের মতো টিকিট কেটে।
পুলিশ তাঁদের শিল্পগ্রাম পার্কিংয়ের কাছে আটকে দিয়েছে বটে। কিন্তু যাওয়ার আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রজ অঞ্চলের সভাপতি আশিস আর্য বলে গিয়েছেন, ‘‘আমরা গেরুয়া পরে তাজমহলের ভিতরে গিয়ে হনুমানচালিসা পড়তে চেয়েছিলাম। কারণ আমরা তাজমহলকে ‘তেজোমহালয়’ বলে মনে করি।’’ পুলিশ আগরা শহরের আরও কিছু এলাকা থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সেবাভারতী এবং দুর্গাবাহিনীর সদস্যদের আটক করে থানায় নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাঁদের ‘দাবায়ে’ রাখতে পারা যায়নি। তাঁরা সকলে থানার মধ্যেই উচ্চস্বরে ‘হনুমানচালিসা’ পাঠ (বা, আবৃত্তি) করেছেন। এবং তাঁরাও বলেছেন, তেজোমহালয়ে গিয়ে তাঁরা বজরঙ্গবলির নামকীর্তন করবেনই।
তেজোমহালয়— জানা গেল, শিবের আলয়। শিবঠাকুরের বাড়ি।
কিন্তু তাজমহল যে ‘তেজোমহালয়’, এই তথ্য কোথায় পেলেন? প্রশ্ন শুনে আশিস সম্ভবত ভাবলেন, কোন মূর্খ এবং আহাম্মকের পাল্লায় পড়েছেন! কারণ, তিনি সটান পাল্টা বললেন, ‘‘কেন? এ তো সকলেই জানে! আপনি জানেন না? নাকি আপনার মনে কোনও প্রশ্ন আছে?’’
এর পরেও প্রশ্ন করে কোন বেকুব! এ সব ক্ষেত্রে ‘সোনার কেল্লা’র লালমোহন গাঙ্গুলি হয়ে যাওয়াই (কোনও প্রশ্ন নয়। কোনও প্রশ্ন নয়) বিধেয়। কিন্তু কেন শিবের আলয়ে ‘হনুমানচালিসা’ পাঠ করার অভিযান? আশিস বলছেন, ‘‘এখানে কিছু লোক হিজাব বিতর্ককে সামনে এনে বিধানসভা ভোটে মেরুকরণ করতে চাইছে। আমরা তারই প্রতিবাদে হনুমানচালিসা পাঠের কর্মসূচি নিয়েছিলাম।’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তাজমহল আর ভালবাসার নিশান নয়। রাজনীতির ঘুঁটি। তাজমহলও!
২১২ বর্গ কিলোমিটারের আগরা জেলা জনসংখ্যার দিক থেকে উত্তরপ্রদেশে চতুর্থ। লোকসভা কেন্দ্র দু’টি— আগরা এবং ফতেপুর সিক্রি। আগরার লোকসভা সাংসদ বিজেপি-র। ২০০৯ থেকে টানা তিন বার এই কেন্দ্রে বিজেপি জিতেছে। তার আগে দু’বার সমাজবাদী পার্টির টিকিটে জিতেছিলেন অভিনেতা রাজ বব্বর। আগরা জেলায় মোট ৯টি বিধানসভা। ২০১৭ সালে সবক’টি পেয়েছিল বিজেপি। এ বারেও পাবে। বুক ফুলিয়ে বলছেন শহরের বাসিন্দা হিন্দুরা। শীতের সকালে তাজমহলের পিছন দিকটায় যমুনার পারে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে রাজিন্দর সিংহ বলছিলেন, ‘‘আগরা শহরে মুসলিমরা আছে। কিন্তু ওরা বিজেপি-কে হারাতে পারবে না।’’
আপনি জাতিতে কী? বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তারক্ষী বলেন, ‘‘ক্ষত্রিয়!’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, মোগল শাসনে এই আগরা শহর হয়ে উঠেছিল শিল্প, বাণিজ্য এবং ধার্মিক রীতি-রেওয়াজ শিক্ষার অন্যতম উৎকর্ষকেন্দ্র। সম্রাট শাহজাহান একটা সময়ে এই শহরের নাম রেখেছিলেন ‘আকবরাবাদ’। তাঁর পিতামহ সম্রাট আকবরের নামে। কিন্তু আদতে এটির উদ্ভব হিন্দি শব্দ ‘আগর’ থেকে। যার অর্থ নুনের পাত্র বা নুনদানি। কারণ, প্রাচীনকালে এই শহরের মাটি ছিল কালো রঙের এবং তখন এই মাটিকে জ্বাল দিয়ে বাষ্প বার করে দিয়ে তা থেকে নুন তৈরি হত।
আবার হিন্দুরা বলেন, সংস্কৃত ‘অগ্র’ থেকে এসেছে এই নাম। আদতে ‘অগ্রবন’। অনেক অরণ্যের প্রথমটি। যেখানে কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিলেন।
তাজমহলের চত্বরে দাঁড়িয়ে বিবিধ ব্যাখ্যার কথা মনে আসছিল। সামনে শীর্ণকায় যমুনা নদী। তার এক প্রান্তে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি— তাজমহল। অন্যপ্রান্তে মলিন আগরা দুর্গ। যেখানে বন্দি শাহজাহান এক ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ দিয়ে চেয়ে দেখতেন তাঁর সাধের তাজমহলকে। তাজমহল আছে। কিন্তু সেই শাহজাহানও নেই। সেই যমুনাও নেই।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একুশ বছর আগের সেই বাজপেয়ী নেই। সেই ‘লাভার্স বেঞ্চ’ নেই। সেই আগরাও নেই। চিরবৈরীদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই প্রেমের শহরে আমন্ত্রণ করেছিলেন দু’দেশের মধ্যে ভালবাসার পথ বার করার আলোচনা করতে। একুশ বছর পর মেরুকরণের রাজনীতির পিঠে সওয়ার রাজনীতিকরা সেই প্রেমের শহরের বিশ্ববিখ্যাত প্রণয়-অভিজ্ঞানের নাম বদলে তাকে রাজনীতির ঘুঁটি করতে চাইছে।
বান্টি-বাবলিও এতটা ভাবেনি। অষ্টম আশ্চর্য! (চলবে)