সরকারি কোষাগার প্রায় খালি। দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশ। এই অবস্থায় হাতিয়ার কিনতে চলেছে পাকিস্তান। সেই লক্ষ্যে এ বার তুরস্কের দ্বারস্থ হয়েছে ইসলামাবাদ। ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’টির থেকে যুদ্ধবিমান আমদানি করতে চাইছে ভারতের পশ্চিম পারের প্রতিবেশী।
সম্প্রতি প্রতিরক্ষা এবং শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে তুরস্কের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসলামাবাদ। সূত্রের খবর, সেখানেই আঙ্কারা থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান আমদানির ব্যাপারে এক প্রস্থ আলোচনা সেরেছে শাহবাজ শরিফ সরকার। বৈঠকে পাক বায়ুসেনার পদস্থ কর্তারা হাজির ছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
পাক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, লড়াকু জেটের পাশাপাশি তুরস্কের সহযোগিতায় ঘরের মাটিতে অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা কর্তাদের। আর তাই কপ্টারের নকশা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করেছেন তাঁরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দুই দেশের অন্তত ৩২টি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা।
২০২৩ সালের জুলাইতে প্রথম বার আঙ্কারা থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’ স্টেলথ লড়াকু জেট ইসলামাবাদ আমদানি করতে চলেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ‘দ্য ডন’ বা ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে’র মতো জনপ্রিয় পাক সংবাদ সংস্থাগুলি এ সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেড় বছরের বেশি সময় গড়িয়ে গেলেও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত রূপ পায়নি।
পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘টার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’ বা টিএআই। ২০২৩ সালে এর প্রথম মডেল তৈরি করে তারা। ঠিক তার পরের বছর (পড়ুন ২০২৪) ‘কান’কে আকাশে ওড়ায় তুরস্কের বায়ুসেনা।
আঙ্কারার অস্ত্রাগারে আমেরিকার তৈরি ‘এফ-১৬ ফ্যালকন’ লড়াকু জেট রয়েছে। এগুলি পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেখানে পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’কে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান। সূত্রের খবর, ২০৩০ সাল থেকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ওই যুদ্ধবিমান পুরোপুরি ভাবে ব্যবহার করা শুরু করবে তুরস্কের বায়ু সেনা।
‘কানে’র নির্মাণকারী সংস্থা টিএআই জানিয়েছে, এটি প্রকৃতপক্ষে একটি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনার হাতে থাকা ‘এফ-৩৫’ লড়াকু জেটের আদলে একে তৈরি করেছেন তুরস্কের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। বর্তমানে একে আরও উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা।
‘ইউরেশিয়ান টাইমসে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনই ‘কান’ যুদ্ধবিমান আমদানির ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করবে না তুরস্ক। তবে লড়াকু জেট নির্মাণ প্রকল্পে ইসলামাবাদকে সামিল করতে পারে আঙ্কারা। তবে পাক অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ এই বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে ১০ বার ভাবতে হবে এর্ডোগানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে।
এই বিষয়ে পাক বায়ুসেনার একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘ইউরেশিয়ান টাইমস্’ লিখেছে, ‘‘ইসলামাবাদ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবে বায়ুসেনার ঘাঁটিগুলিতে আগামী দিনে ‘কান’ সামিল হবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিষয়টি যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।’’
অন্য দিকে তুরস্কের বিমান নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন অবসরপ্রাপ্ত পাক বায়ুসেনা অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন জনসন চাকো। তাঁর দাবি, ‘‘তুরস্কের কান লড়াকু জেট নির্মাণ প্রকল্পে সামিল হয়েছে ইসলামাবাদ। কিছু দিনের মধ্যেই পাকভূমিতে যুদ্ধবিমানের কিছু অনুসারী শিল্প গড়ে উঠবে। ফলে বাড়বে কাজের সুযোগ।’’
সম্প্রতি চিন থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ৪০টি ‘জে-৩৫’ যুদ্ধবিমান আমদানির জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে শাহবাজ শরিফ সরকার। আগামী দু’বছরের মধ্যে সেগুলি পাক বায়ুসেনাকে বেজিং সরবরাহ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সময়সীমার মধ্যে তুরস্কের ‘কান’ লড়াকু জেট নিয়েও উৎসাহ দেখাচ্ছে রাওয়ালপিন্ডি। অর্থাৎ একসঙ্গে দু’ধরনের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অস্ত্রাগারে রাখতে চাইছে পাক বায়ুসেনা।
এ ছাড়া চিনের থেকে ‘জে-৩১’ যুদ্ধবিমান আমদানি করছে ইসলামাবাদ। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) জানুয়ারি মাসে পাক বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জাহের আহমেদ বাবের সিধু বলেন, ‘‘খুব দ্রুত চিনা লড়াকু জেটগুলি বাহিনীতে সামিল করা হবে।’’ ওই যুদ্ধবিমান এখনও বেজিং সরবরাহ করেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে ঘরের মাটিতে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করতে বিশেষ একটি প্রকল্প শুরু করেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। ওই প্রকল্পের কোড নাম ছিল ‘আজম’। সেখানে কিছু হামলাকারী ড্রোন নির্মাণেরও কথা ছিল। প্রকল্পটি এখনও সাফল্যের মুখ দেখেনি।
হাতিয়ারের ক্ষেত্রে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। কয়েক বছর আগে আঙ্কারার থেকে অত্যাধুনিক ‘বেরেক্টর টিবি২’ নামের হামলাকারী ড্রোন কেনে ইসলামাবাদ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক বা পশ্চিম এশিয়ার সংঘাত – বিভিন্ন রণাঙ্গনে ইতিমধ্যেই সুনাম অর্জন করেছে তুরস্কের এই মানব বিহীন উড়ুক্কু যান।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আকাশের লড়াইতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সমকক্ষ হতে চাইছে পাক বায়ুসেনা। আর তাই ক্রমাগত যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
অন্য দিকে পঞ্চম প্রজন্মের শতাধিক লড়াকু জেট বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সূত্রের খবর, রাশিয়ার থেকে ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’ বা আমেরিকা থেকে ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ যুদ্ধবিমান কিনতে পারে নয়াদিল্লি। তবে সেগুলি ঘরের মাটিতে তৈরির শর্ত দিতে পারে কেন্দ্র।
এ ছাড়া সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘অ্যাডভান্স মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট’ বা অ্যামকা তৈরিতে হাত দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লড়াকু জেট প্রাণ পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সূত্রের খবর, পাকিস্তানের ‘আজম’ প্রকল্পের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে অ্যামকা।
পাক বায়ুসেনা ভারতের আগে পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেট হাতে পেয়ে গেলে চিন্তা বাড়বে নয়াদিল্লির। আর তাই দ্রুত প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলার উপর জোর দিয়েছেন প্রাক্তন বায়ু সেনাকর্তারা। কারণ, চুক্তি হলে রাশিয়া বা আমেরিকা থেকে যুদ্ধবিমান পেতে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরও দু’বছর।
সব ছবি: সংগৃহীত।